মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ, প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা প্রধান অনীত থাপা, হামরো পার্টির প্রধান অজয় এডওয়ার্ড (বাঁ দিক থেকে)। — ফাইল ছবি।
ক্যালেন্ডার বলছে, ২৩ বছর পর আবার পঞ্চায়েতে প্রতিনিধি বাছতে ভোট দিল দার্জিলিং পাহাড়। তবে সমতলের মতো সেখানে সন্ত্রাস বা হিংসার অভিযোগ ওঠেনি। ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়নি। নেই হুমকি বা ধমকির অভিযোগের পাহাড়ও। পাহাড়ের রীতি মেনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ভোট দিয়েছেন মানুষ। ভোটবাক্স খোলার পরের প্রবণতা বলছে, নিঃশব্দেই আরও একটি বদলের সূচনা হয়ে গেল পাহাড়ে।
এত দিন যে রাজনৈতিক সমীকরণ দেখতে অভ্যস্ত ছিল পাহাড়, তাতে এল বড়সড় বদল। পাহাড়ে সংগঠিত শক্তি হিসাবে উঠে এল অনীত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ব্যাপার হল, গ্রামীণ পাহাড়ে এ বারই প্রথম খাতা খুলল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলও।
একেবারে যে অপ্রত্যাশিত ফল, তা বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে, পুর নির্বাচন এবং জিটিএ ভোটে যে বদলের সূচনা হয়েছিল পাহাড়ে, দ্বিস্তর পঞ্চায়েতের ফলে তা আরও পাকাপোক্ত হল। আগামী লোকসভায় তার ফসল কি ঘরে তুলতে পারবে পাহাড়ের বিজেপি-বিরোধী শিবির? সেটি অনেক দূরের প্রশ্ন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে পাহাড়ের ফলাফলে গেরুয়া শিবিরের উদ্বেগ এবং চিন্তার কারণ রয়েছে।
গত বেশ কয়েক দশক ধরে পাহাড়ের রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানোর চল ছিল রাজ্যভাগের দাবি তোলা রাজনৈতিক দলগুলিরই। সে সুবাস ঘিষিংয়ের জিএনএলএফ হোক বা তাঁকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতার ছড়ি হাতে তুলে নেওয়া বিমল গুরুঙের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। কিন্তু হালফিলের পাহাড়ে কি সামগ্রিক ভাবেই গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে এই দলগুলি? রাজ্যভাগের দাবি কি আর পাহাড়বাসীর নিরঙ্কুশ দাবি হয়ে থাকছে না? দ্বিস্তর পঞ্চায়েতের ফলে কিন্তু তেমনই ইঙ্গিত। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে মহাজোট গড়ে তৃণমূল এবং অনীত থাপার প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার টক্কর নিতে নেমেছিল জনমুক্তি মোর্চা, জিএনএলএফ, হামরো পার্টি এবং অবশ্যই বিজেপি। কিন্তু ভোটের ফল হতাশ করবে তাদের।
দার্জিলিংয়ের ৫৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতে অনীতের প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা একাই দখল করেছে ৩৪৯টি আসন। পাঁচটি আসন জিতে গ্রামীণ দার্জিলিংয়ে খাতা খুলে ফেলেছে তৃণমূলও। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ৫৯টি আসন। নির্দল প্রার্থীরা জিতেছেন ১৮৫টি আসনে। পঞ্চায়েত সমিতির মোট ১৫৬টি আসনে তৃণমূল খাতা খুলতে না পারলেও জোটসঙ্গী প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা একাই দখল করেছে ৯৬টি আসন। সেখানে বিজেপি পেয়েছে ১৯টি আসন। ৪১ জন নির্দল প্রার্থী জিতেছেন।
কালিম্পংয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন ২৮১টি। যার মধ্যে প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা পেয়েছে ১৬৮টি আসন। সামসিংয়ে একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল জিতেছে। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ২৯টি আসন। গ্রাম পঞ্চায়েতে ৮২ জন নির্দল প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। কালিম্পংয়ে মোট পঞ্চায়েত সমিতির সংখ্যা ৭৬টি। তার মধ্যে অনীতের প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা ৩৯টি আসন পেয়েছে। বিজেপি প্রার্থীরা জিতেছেন ৭টি আসন। এ ছাড়া ৩০টি আসনে নির্দল প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন।
বিজেপির পৌরোহিত্যে পাহাড়ে তৃণমূল বিরোধী মহাজোট গঠিত হলেও বিজেপি প্রার্থী দিয়েছিল দার্জিলিং এবং কালিম্পংয়ে। পাশাপাশি, মহাজোটের প্রার্থীরা নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে মহাজোট ছাড়াও নির্দল প্রার্থীরা লড়াইয়ে ছিলেন। দার্জিলিংয়ের দ্বিস্তরীয় ভোটে প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা বিপুল জয় পেলেও কালিম্পং নিয়ে মাথাব্যথা থাকবে অনীতের। ভোটের হিসাব বলছে, পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্দল এবং বিজেপি মিলে মোট ৩৭টি আসন দখল করেছে। সেখানে অনীতের দল একা পেয়েছে ৩৯টি আসন। এই অবস্থায় ঘোড়া কেনাবেচার পরিস্থিতি তৈরি হবে না তো কালিম্পংয়ে?
যদিও সামগ্রিক ভাবে গ্রামীণ পাহাড়ের ফলাফলের সাপেক্ষে তার রাজনৈতিক চরিত্রের আমূল বদলের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যে ফল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের কাছেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। গ্রামীণ পাহাড়ে প্রথম বার খাতা খুলে উচ্ছ্বসিত রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের তরফে পাহাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অরূপ বিশ্বাস। পাহাড়ে তৃণমূলের ফল নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখেছেন পাহাড়ের মানুষ।’’
প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার কেন্দ্রীয় মুখপাত্র শক্তিপ্রসাদ শর্মা বলেন, ‘‘বিজেপির উপর পাহাড়ের মানুষ আস্থা হারিয়েছে। বিজেপি এবং তার বন্ধুরা এত দিন আবেগের রাজনীতি করে এসেছেন। পাহাড়ের মানুষ এখন রাজনীতি সচেতন হচ্ছেন। তাই বিজেপির মিথ্যাচারের খেলা ধরে ফেলছেন। মানুষ উন্নয়ন চাইছেন। আমরা সেটাই করছি। তাই পাহাড়ের মানুষের আশীর্বাদও আমাদের সঙ্গেই রয়েছে। আমরাই পাহাড়ের ভবিষ্যৎ। জিটিএ, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত মিলিয়ে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পাহাড়ের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ করব আমরা।’’
দার্জিলিংয়ের বাসিন্দা রতনকুমার মুখিয়া বুধবার বলেন, ‘‘রাজনৈতিক পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন। না হলে যে কেউ নিজেকে সব কিছুর অধিকারী মনে করে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাহাড় সব সময়ই রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। এর আগে বিমল গুরুঙ ছিলেন পাহাড়ের শেষ কথা। এখন অনীত থাপা এসেছেন। পঞ্চায়েতে তাঁরা ভাল করেছেন। দেখতে চাই, তাঁরা কী ভাবে পাহাড় চালান। রাজনৈতিক পরিবর্তন সমাজব্যবস্থার পক্ষে ভাল।’’
পাহাড়ের রাজনীতিতে ইদানীং কালে যে ‘বদল’, তাতে এক দিকে প্রবল সাড়া জাগিয়ে শুরু-করা হামরো পার্টি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বড় শক্তি হিসাবে উঠে আসছে প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা। গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে তৃণমূল। এই অবস্থায় রাজ্যভাগের দাবির চেয়েও প্রাধান্য পাচ্ছে স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়। তারই স্পষ্ট প্রতিফলন পাহাড়ের দ্বিস্তরীয় পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে।