প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ভোটের পরে খোশমেজাজে ছিলেন না মুর্শিদাবাদের বাম-কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রকাশ্যে তাঁরা শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত ভোটে ‘সন্ত্রাস এবং লুট’-এর অভিযোগ তুললেও ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিয়েছিলেন, ‘ভোট করতে’ নিচুতলার যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার, তা ভোটের দিন বুথ স্তরে ছিল না। বাম-কংগ্রেসের সেই আশঙ্কার কথা লেখাও হয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইনে।
বুধবার যখন ফলাফল স্পষ্ট, তখন বোঝা গেল, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ‘গড়’ বলে খ্যাত মুর্শিদাবাদ জেলায় প়ঞ্চায়েতের তিন স্তরেই কার্যত ঝড় বইয়ে দিয়ে জিতেছে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ— বাম-কংগ্রেসের মিলিত আসন ত়ৃণমূলের থেকে বহু দূরে। যদিও জেলার বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘তৃণমূল যে ভাবে ভোট লুট আর গণনাকেন্দ্রে কারচুপি করেছে, তাতে এটা ওদের জয় নয়, কেবল আস্ফালনের সংখ্যা। এই ভোটে ত়ৃণমূল কলঙ্কের নজির গড়েছে।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক জ়ামির মোল্লার কথায়, ‘‘তৃণমূলও জানে তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। তাই ওদের ভোট-ডাকাতির রাস্তায় যেতে হয়েছে। যেখানে ভোট লুট করতে পারেনি, সেই সব জায়গায় গণনাকেন্দ্রে রাহাজানি করেছে।’’ আর পাল্টা ত়ৃণমূলের বহরমপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি শাওনি সিংহ রায় বলছেন, ‘‘ভোটের দিন কংগ্রেস-সিপিএমের সন্ত্রাসে বেলডাঙা, রেজিনগরে আমাদের কর্মীরা খুন হয়েছিলেন। ওরা বোমা-বন্দুকের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিল। মানুষ ব্যালটে জবাব দিয়েছেন!’’
মুর্শিদাবাদে গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন ৫,৫৯১টি। তৃণমূল একাই পেয়েছে ২,৫৪২টি আসন। বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছে ১,৬০০টি আসন। সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় বিজেপি পেয়েছে ৪৯৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন। বাদবাকি আসন পেয়েছে নির্দল ও অন্যান্যরা (তাদের মধ্যে কিছু আসন রয়েছে আইএসএফের)। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ছবিটা একই। জেলা পরিষদে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেতে চলেছে শাসক তৃণমূল। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদে মোট আসন ৭৮টি। বুধবার বেলা ১টা পর্যন্ত খবর, জেলা পরিষদে তৃণমূল ৪৮টি আসন পেরিয়ে গিয়েছে। জেলা পরিষদে এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস-সিপিএমের মিলিত আসন সংখ্যা ছয়। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জেলা পরিষদে বিজেপি খাতা খুলতে পারেনি।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের বড় ব্যবধানে পরাজয় এবং বাম-কংগ্রেস জোটপ্রার্থী হিসাবে কংগ্রেসের বাইরন বিশ্বাসের জয় বাংলার রাজনীতিকে আন্দোলিত করেছিল। আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সাগরদিঘি। সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণ নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। কিঞ্চিৎ ‘উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা’ দেখা গিয়েছিল শাসক শিবিরের মধ্যেও। অনেকেই মনে করেছিলেন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ধারায় সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের থেকে সরে কংগ্রেস এবং বাম শিবিরের দিকে গিয়েছে সাগরদিঘিতে। যদিও তৃণমূল তা সামগ্রিক ভাবে মানতে চায়নি। বরং তারা বাইরনকে দলে নিয়ে কংগ্রেসকে বিধানসভায় আবার ‘শূন্য’ করে ছেড়েছে! কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী বাইরনকে তৃণমূলে নেওয়া নিয়েও রাজ্যের রাজনীতিতে শাসক শিবিরের সমালোচনা হয়েছিল। এমনও অনেকে বলেছিলেন যে, এর ফলে সংখ্যালঘুরা আরও ‘বিমুখ’ হয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে তা দেখা গেল না।
মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েতের এই ফল দেখে রাজনৈতিক মহলে লোকসভা নির্বাচন ও বহরমপুরে অধীরের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে অধীরের জেলায় কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য দুর্গ ভাঙতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। সে বারই প্রথম মুর্শিদাবাদ থেকে দু’টি লোকসভার আসন জেতে তৃণমূল— মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুর। কিন্তু অধীরকে হারানো যায়নি। ব্যবধান কমলেও অধীর নিজের বহরমপুর আসনটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে অনেকেই মনে করেন, সেই জয় এসেছিল অনেকটাই অধীরের ‘ব্যক্তিগত ক্যারিশমা’র জোরে। বুধবার সেই অধীর বলেছেন, ‘‘আমাদের জন্য আর সুস্থ, সবল, নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশা আর নেই।’’ ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট আর এক বছরও দূরে নয়। পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে অধীরের চিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছেন কংগ্রেসেরই একাংশ। এবার অবশ্য শুভেন্দু তৃণমূলে নেই। কিন্তু মুর্শিদাবাদে ‘নবজোয়ার যাত্রা’র সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তাঁর ‘বিশেষ নজর’ রয়েছে বহরমপুরের উপর। প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এমনও জানিয়েছিলেন যে, দল চাইলে তিনি বহরমপুরে লড়তে প্রস্তুত!
তবে মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট আর লোকসভা ভোট এক নয়। লোকসভা ভোট হবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে। ব্যালট লুট করা, গণনাকেন্দ্র দখল করার মতো বিষয় এত বড় আকারে ঘটবে না বলেই মনে করছেন তাঁরা। অধীর-ঘনিষ্ঠ নেতা মনোজের যেমন বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে মানুষ অনেক জায়গায় প্রতিরোধ করেছেন। লোকসভায় তৃণমূলকে গণপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।’’