টেটের জট: আন্দোলন, আত্মহত্যাও

নিয়োগপত্র নেওয়ার আগে কোনও জেলায় মুচলেকায় সই করতে হচ্ছে প্রার্থীদের। কোথাও আবার কাউন্সিলিংয়ের পরে নিয়োগপত্রই মিলছে না বলে অভিযোগ। টাকা লেনদেন-সহ একাধিক অনিয়ম আড়াল করতেই সফল আবেদনকারীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি বলে অভিযোগ। এই নিয়ে উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই চলছে বিক্ষোভ। ঘুরে দেখল আনন্দবাজার। এ দিন প্রথম পর্বনিয়োগপত্র নেওয়ার আগে কোনও জেলায় মুচলেকায় সই করতে হচ্ছে প্রার্থীদের। কোথাও আবার কাউন্সিলিংয়ের পরে নিয়োগপত্রই মিলছে না বলে অভিযোগ। টাকা লেনদেন-সহ একাধিক অনিয়ম আড়াল করতেই সফল আবেদনকারীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি বলে অভিযোগ। এই নিয়ে উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই চলছে বিক্ষোভ। ঘুরে দেখল আনন্দবাজার। এ দিন প্রথম পর্ব

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:২৭
Share:

রায়গঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের কার্যালয়ের সামনে বাম ছাত্র-যুব সংঠনের।

আন্দোলনের হুমকি

Advertisement

মালদহ: টেট উত্তীর্ণ তাঁরা। কাউন্সেলিংয়ের পরেও নিয়োগপত্র মেলেনি। এই নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পথে নামলেন জেলার পার্শ্বশিক্ষকরা। শুক্রবার দুপুরে মালদহের ইংরেজবাজার শহর জুড়ে মিছিল করেন তাঁরা। তার পর দ্রুত নিয়োগের দাবিতে জেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দেন।

তাঁদের অভিযোগ, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করার সময় পার্শ্বশিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট আসন সংরক্ষিত রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। সেই বিজ্ঞপ্তিতে উচ্চ প্রাথমিক কিংবা প্রাথমিকের পার্শ্বশিক্ষকের বিষয়ে উল্লেখ ছিল না। এ বার লিখিত, মৌখিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ও কাউন্সেলিংয়ের শেষে মঙ্গলবার নিয়োগপত্রের জন্য ভিড় জমান তাঁরা। অভিযোগ, নিয়োগপত্র দেওয়ার নিয়ে প্রথম থেকেই টালবাহানা করতে থাকেন কর্তৃপক্ষ। ওই দিন সন্ধ্যের পরে কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, উচ্চ প্রাথমিকের পার্শ্বশিক্ষকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে দেন ওই পার্শ্বশিক্ষকেরা। তার পরে আশ্বাস দেওয়া হলেও এ দিনও নিয়োগপত্র না পেয়ে জনা পঞ্চাশেক চাকরিপ্রার্থী শহরে মিছিল করে গিয়ে অতিরিক্ত জেলা শাসক, জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শককে স্মারকলিপি দেন। দ্রুত নিয়োগ না হলে আগামীতে বৃহত্তর আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দেন।

Advertisement

কেউ পেলেন, কেউ না

দক্ষিণ দিনাজপুর: বালুরঘাটের চকভৃগুর টেট উত্তীর্ণ প্রার্থী রাজু দাসকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁর প্রতিবন্ধী সংশাপত্র রিনিউ বা পুনর্নবীকরণ করা হয়নি বলে। রাজুর বক্তব্য, ১০ বছর অন্তর এই সংশাপত্র রিনিউ করতে হয়। কিন্তু ডিপিএসসি কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, না, রিনিউ করতে হয় পাঁচ বছর অন্তর। শেষে কলকাতার শিক্ষা দফতর জানায়, দশ বছরই ঠিক। এর পরে রাজু নিয়োগপত্র পান।

কিন্তু এতটা ভাগ্য ভাল নয় একই এলাকার টেট উত্তীর্ণ প্রার্থী পলাশ বর্মনের। তিনি ডিপিএসসি-তে কাউন্সেলিংয়ে এসেছেন। অথচ সংশাপত্রে ভুল রয়েছে বলে অভিযোগ তোলায় তাঁর নিয়োগ আটকে রয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি থানার নুরুল্লাকুড়ি এলাকায় তৃণমূল ছাত্র নেতা আব্দুর রহিম (২৪) আত্মহত্যা করেন। তার পরেই অভিযোগ ওঠে, টাকা দিয়ে প্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার একটি চক্র কাজ করছে জেলায়। এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটে যখন সরাসরি এসএমএসে চাকরিপ্রার্থীকে খবর দেওয়ার বিষয়টা আলোচনায় ওঠে, অনেক প্রার্থী সংশয়ে ভুগতে থাকেন। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজু দাস বা পলাশ বর্মনের ঘটনা। জেলায় অবশ্য ১৩০০টি শূন্য পদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭০০ পদ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তবু আব্দুর রহিমের ঘটনায় সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ, টেটে চাকরি পেতে রহিম স্থানীয় এক তৃণমূল নেতাকে মোটা টাকা দিয়েছিলেন। পরপর তিনটি নিয়োগ তালিকাতেও তার নাম না ওঠায় হতাশায় তিনি আত্মঘাতী হন বলে আত্মীয়দের অভিযোগ। বস্তুত, তৃণমূল ছাত্র নেতা আব্দুর রহিম লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি বলে অভিযোগ। টেটের লিখিত পরীক্ষার আগে যারা চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের এখনও পর্যন্ত নিয়োগ তালিকায় নাম ওঠেনি বলেই শোনা গিয়েছে। এক তৃণমূল নেতার কথায়, জেলার অনেক ছোট-মাঝারি নেতাই চাকরির জন্য মাথা পিছু ৮-১০ লক্ষ টাকা করে তুলেছেন। তাঁদের শিক্ষা দিতেই কঠোর হয়েছে বাছাইপর্ব।

বিক্ষোভ, আশ্বাস

উত্তর দিনাজপুর: স্মারকলিপি জমা দেওয়ার জন্য এসএফআই ও ডিওয়াইএফআইকে শুক্রবার সময় দিয়েছিলেন জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান। কিন্তু এ দিন বিক্ষোভকারীরা কর্ণজোড়া যেতেই তাঁদের বাইরে আটকে দেয় পুলিশ। প্রথমে তাঁদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, সংসদের গেটে লাথি মারার পরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। শেষে ঠিক হয়, দুই সংগঠনের চার জন সদস্যকে ভিতরে যেতে দেওয়া হবে। কিন্তু তাঁরা গিয়ে দেখেন চেয়ারম্যানই নেই। সংসদ সূত্রে বলা হয়, টেট নিয়ে যে জট তৈরি হয়েছে, তা কাটাতেই তিনি কলকাতা গিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রায় এক ঘণ্টা সংসদের কর্মীদের ঘেরাও করে রাখেন এসএফআই ও ডিওয়াইএফের সমর্থকেরা। শেষ পুলিশ-প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে ঘেরাও ওঠে।

টেট নিয়ে আন্দোলন মালদহে।

এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক গোপাল দাস ও ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক কার্তিক দাসের দাবি, জেলায় প্রাথমিক শিক্ষকের শূন্যপদ কত, কত জনকে নিয়োগ করা হয়েছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণ নীতি মানা হয়েছে কি না, সফল চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের তালিকা কেন প্রকাশ করা হয়নি— এই সব বিষয়ে সংসদ কর্তৃপক্ষ কোনও তথ্য ও সদুত্তর দিতে পারেননি। যদিও চেয়ারম্যান জাহিদ আলম আরজুর অবশ্য দাবি, সরকারি নিয়ম মেনেই নিয়োগ হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ ভিত্তিহীন। সংসদ কর্তৃপক্ষের দাবি, জেলায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের টেটের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২৭১৪ জন সফল চাকরিপ্রার্থীকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৫ জন সফল চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে ৩৭ জন প্যারাটিচার ক্যাটাগরিতে আবেদন করেছিলেন। কাউন্সেলিংয়ের সময়ে তাঁরা সেই কাজের শংসাপত্র বা নথি দেখাতে না পারায় তাঁদের নিয়োগপত্র দেওয়া যায়নি। বাকি ৮ জনের কোনও না কোনও শংসাপত্রে অসঙ্গতি থাকায় নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে গিয়েছে।

জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক মৃণ্ময় ঘোষের দাবি, রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকে সফল প্রার্থীদের প্যানেল প্রকাশ করা হয়েছিল। তাই যাঁদের নিয়োগ আটকে গিয়েছে, তাঁদেরকে কলকাতায় পর্ষদের কার্যালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

—নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement