পরিণয়: মেয়েকে সম্প্রদান করছেন পূর্ণিমা। ছবি: সন্দীপ পাল
বাসি বিয়ে সেরেই কলেজের পরীক্ষায় বসলেন নববধূ। তাঁকে আগের দিন বিয়ের রাতে সম্প্রদান করেছেন মা। কনের বাড়িতে নয়, বরের বাড়িতেই বসেছিল বিয়ের আসর। কনে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে। এই বিয়ে ঘিরে নানা ব্যতিক্রমী গল্প, যে সবের পিছনে রয়েছে এক মায়ের লড়াইয়ের কাহিনি। মেয়েকে সম্প্রদান করবেন কে? জিজ্ঞেস করেছিলেন পুরোহিত! পূর্ণিমা বলেছিলেন, ‘‘আমি করব। আমি মেয়ের মা। আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই।’’
লড়াই শুরু হয়েছিল বছর-কুড়ি আগে। মেয়ের জন্মের সঙ্গেই। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি— দু’বাড়ির যোগ মুছে যায় পূর্ণিমার জীবন থেকে। জলপাইগুড়ির রায়কত পাড়ার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার হোমে মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন পূর্ণিমা। নিজে পড়েছিলেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। চেয়েছিলেন, মেয়ে পড়াশোনা করুক। তাই বাসাবাড়িতে কাজ করে মেয়ের শখ-আবদার পূরণ করেছেন। সেই মেয়েরই বিয়ে হল ৩ জুলাই। সম্প্রদান করলেন মা।
প্রচলিত একটি ধারা অনুযায়ী সাধারণত পাত্রীর বাড়িতেই বরযাত্রীরা যান এবং সেখানেই বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু পূর্ণিমাদের নিজস্ব বাড়ি নেই। তাই হোমে এসে পাত্রপক্ষ আর্শীবাদ করে পাত্রীকে নিয়ে রওনা হয় পাত্রের বাড়িতে। সেখানেই বসে বিয়ের আসর। হোমের সুপার মমতা সেন বলেন, ‘‘মানুষের ভালর জন্যই প্রথা। তাই অসুবিধা কোথায়!’’
পাত্রী সংস্কৃত সাম্মানিকের পড়ুয়া। জলপাইগুড়ির প্রসন্নদেব কলেজে। বিয়ের পরের দিন, ৪ জুলাই থেকে কলেজে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বাসি বিয়ের দিনই পরীক্ষায় বসে পড়েন নববধূ। অনলাইন পরীক্ষা। রানিনগরের শ্বশুরবাড়িতে বসে পরীক্ষা দেন নববধূ। পরীক্ষা শেষে সেই খাতা কলেজে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন তাঁর স্বামী এবং দাদা। বধূর স্বামী একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে চাকরিতে ঢুকেছেন। স্নাতক হতে যাওয়া স্ত্রীর পরীক্ষার খাতা কলেজে পৌঁছে দিয়ে চলেছেন পরীক্ষার প্রতিটি দিন। নববর পবিত্র বললেন, ‘‘আমার স্ত্রী যদি চান, তবে স্নাতকোত্তর কেন, আরও অনেক দূর পড়াশোনা করবেন। আমি, আমরা সব সাহায্য করব।’’
জলপাইগুড়ির রায়কত পাড়ার হোমে পূর্ণিমা রান্না করেন। হোমের কয়েক জন এবং আশপাশের পড়শিরা গিয়েছিলেন রানিনগরে পাত্রের বাড়িতে বিয়ের আসরে। বিয়ের সময়ের ছবি তাঁরা তুলেছেন ক্যামেরায়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গলায় গামছা দিয়ে মেয়েকে সম্প্রদান করছেন পূর্ণিমা। মায়েদের সম্প্রদানের নজির নতুন নয়। তবে, প্রান্তিক মহিলার ক্ষেত্রে তা কিছুটা বিরলই। পূর্ণিমা বলেন, ‘‘প্রথা ভাঙা-গড়া জানি না। আমি ছাড়া আমার মেয়েকে আর কে সম্প্রদান করবেন! এতগুলো বছরের লড়াইটা তো আমারই!’’