নিয়ন্ত্রণের বার্তা, তবু হিংসা থামছে না

ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস অব্যাহত ফলাফলের দু’দিন পরেও। অভিযোগ, বিপুল জনসমর্থন পেয়েও কলকাতা-সহ শহরতলির একাধিক স্থানে বিরোধীদের উপর হামলা চলছে। একই সঙ্গে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার দলেরই কিছু নেতা-সমর্থক। বাম সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং তাদের মারধরের অভিযোগের পাশাপাশি তৃণমূলের কর্মীর বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০৩:৩৫
Share:

সিপিএমের অফিসে ভাঙচুরের পর। দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে। —নিজস্ব চিত্র।

ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস অব্যাহত ফলাফলের দু’দিন পরেও। অভিযোগ, বিপুল জনসমর্থন পেয়েও কলকাতা-সহ শহরতলির একাধিক স্থানে বিরোধীদের উপর হামলা চলছে। একই সঙ্গে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার দলেরই কিছু নেতা-সমর্থক। বাম সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং তাদের মারধরের অভিযোগের পাশাপাশি তৃণমূলের কর্মীর বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। একাধিক ক্ষেত্রে তৃণমূলের উপরমহলে ওই সব ঘটনার খবর পৌঁছলে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে বটে, তবে অনেক ঘটনাতেই শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের ‘আক্রোশে’ আতঙ্কিত এলাকার বাম সমর্থকেরা।

Advertisement

আবার দলেরই কয়েক জন নেতার আচরণে সন্ত্রস্ত উত্তর কলকাতার একাধিক তৃণমূল কর্মীও। শাসক দলের কিছু নেতার দৌরাত্ম্যের সামাল দিতে পারছে না পুলিশও। যেমনটা হয়েছে শুক্রবার ও শনিবার রাতে, উত্তর কলকাতার দুই এলাকায়। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই কলকাতা পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইট ছোড়া দিয়ে শুরু। পরে মুহুর্মুহু বোমা পড়ে। শ্যামপুকুর থানার সার্জেন্ট প্রতীক শী এই ঘটনায় আহত হয়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

এলাকাটি বিধায়ক শশী পাঁজার বিধানসভার মধ্যে। কাউন্সিলর সুনন্দা সরকার। এই ঘটনা নিয়ে বিধায়ককে ধরার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সুনন্দাদেবী বলেছেন, ‘‘বাচ্চা ছেলেদের বিষয়। ক্লাবে ক্লাবে কিছু গোলমাল হয়তো হচ্ছে। তবে ঠিক হয়ে যাবে।’’ এর পরে বলেন, ‘‘আমি বাইরে আছি।’’

Advertisement

এই বিধানসভার অন্য এলাকায় শুক্রবার রাতেও গোলমাল হয়েছে। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দর্জিপাড়া বস্তি এলাকায় ওই রাতে এক তৃণমূল নেতার বাড়িতে হামলা হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রে খবর, রাত ১০টা নাগাদ কাটমারবাগানে স্থানীয় তৃণমূল নেতা স্বপন ভদ্রের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়। আক্রমণকারীরা তৃণমূলেরই কর্মী বলে দাবি স্বপনবাবুর। ভাঙচুরের অভিযোগ মিলেছে আরও কয়েকটি বাড়ি থেকেও। ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশের বিশালবাহিনী এবং স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক শশী পাঁজা ঘটনাস্থলে চলে আসেন।

২১ এপ্রিল নির্বাচনের পরেই স্বপন ভদ্রের বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছিল। থানায় অভিযোগও দায়ের করেছিলেন তিনি। পুলিশ সূত্রের দাবি, ভোটের সময় থেকেই ওই এলাকা তৃণমূলের নিজেদের ঝামেলার জেরে উত্তপ্ত ছিল। ফল বেরোতেই বৃহস্পতিবার এ নিয়ে ফের গোলমাল শুরু হয়। গুরুতর আহত হয়ে একজন ভর্তি রয়েছেন হাসপাতালে। এই ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। স্থানীয় কাউন্সিলর মোহন গুপ্তের দাবি, ধৃতরা সবাই স্বপন ভদ্রের অনুগামী। তিনি বলেন, ‘‘স্বপন ভদ্র বরাবরই দল বিরোধী কাজ করছে। ভোটেও দলের হয়ে কাজ করেনি। ফল প্রকাশের পর থেকেই আমাদের কর্মীদের পাড়ায় ঢুকতে দিচ্ছিল না।’’ অভিযোগ অস্বীকার করে স্বপনবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘অভিযোগ ভিত্তিহীন। কখনও দল বিরোধী কাজ করিনি।’’

শশী পাঁজা বলেন, ‘‘স্বপনবাবুর বাড়ি আক্রমণ করানোর জন্য আমি যাইনি। বরং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশকে দিয়ে কয়েক জনকে গ্রেফতার করিয়েছি। এলাকার শান্তি রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন, তা আমিই করেছি।’’

কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় শাসকদল বিরোধীদেরও আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ। শনিবার সকালে বেলেঘাটার চাউলপট্টিতে এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ঢুকে তৃণমূল কর্মীরা ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ। শুক্রবার রাতে বেলেঘাটার রামমোহন মল্লিক গার্ডেন সিপিএম-র জোনাল কমিটির সদস্য মৃণাল রায়চৌধুরীর বাড়ি ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগ উঠেছিল। এই দুটি ঘটনা ছাড়াও বেলেঘাটায় সিপিএমের কয়েক জন কর্মীর বাড়িতেও শুক্রবার রাতে ভাঙচুর এবং হামলার অভিযোগ উঠেছে। শনিবার সকাল থেকেই ওই এলাকায় রয়েছে পুলিশ পিকেট।

শুক্রবার রাত ১১টা নাগাদ কলকাতা পুরসভার ১১১ নম্বর ওয়ার্ডে নারকেলবাগানে সিপিএমের লোকাল কমিটির সম্পাদক শ্যামল লাহিড়ীর বাড়িতে তৃণমূল হামলা করেছে বলে অভিযোগ।

যুধাজিৎ গোস্বামী নামে এক সিপিএম কর্মীকেও মার খেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হামলার সময়ে ওই রাস্তা দিয়ে ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন যুধাজিৎ। হামলাকারীরা তাঁকে লাঠিপেটা করে। থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন শ্যামলবাবু। তৃণমূল নেতারা এই হামলার সঙ্গে দলের যোগের কথা অস্বীকার করেছেন। জেলা থেকে ক্রমাগত হিংসার অভিযোগ আসছে। তা সে উত্তরের কোচবিহার হোক বা দক্ষিণের আরামবাগ। দুর্গাপুরের বেনাচিতিতে শুক্রবার রাতে ভাঙচুর হয়েছে সিপিএমের অফিস। শনিবার আরামবাগের বাতানল দক্ষিণপাড়ায় সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় আলমগীর বাদশা নামে একটি সাত বছরের শিশুও আঘাত পায় বলে অভিযোগ। তাকে পুলিশ আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। এ ছাড়াও আরামবাগের প্রাক্তন বিধায়ক বিনয় দত্তর বাড়িতে ভাঙচুর ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগগুলি শোনার পরে হুগলির জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘‘এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। বিরোধীরা সকলেই নিরাপদে বাড়িতে থাকবেন। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ এলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দল।’’

ভোট পরবর্তী হিংসা রুখতে এ দিন রাজ্যপালের কাছে গিয়েছিল বিজেপির একটি প্রতিনিধি দল। পরে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও আর্জি জানাচ্ছি যাতে হিংসা ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির নতুন যুগ শুরু করে তিনি মানুষের আশা পূরণ করেন।’’ একই আর্জি জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যও। বলেছেন, ‘‘আশা করব মুখ্যমন্ত্রী এই সন্ত্রাস বন্ধে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ করবেন।’’ সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, ‘‘যে সব জায়গায় তৃণমূল জিতেছে এবং খারাপ ফল করেছে, সর্বত্রই আমাদের উপরে হামলা হচ্ছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement