আশ্রয়: কদর কাজীর বাড়ি। নানুরের নিমড়ায়। নিজস্ব চিত্র
চার বছরেরও বেশি সময় ধরে গা-ঢাকা দিয়েছিল সে। এনআইএ বা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজেও ধরতে পারেনি। অবশেষে হুগলির আরামবাগে ধরা পড়ল খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে অভিযুক্ত কদর কাজী। এই কদর হল ওই বিস্ফোরণের মূল চক্রী তথা জেএমবি জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান ওরফে কওসরের শ্যালক। তার বাড়ি নানুরের নিমড়া গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়।
পুলিশ সূত্রে খবর, এক সময় ওই বাড়িতে কওসরের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এনআইএ সূত্রের দাবি, খাগড়াগড় কাণ্ডের বিস্ফোরক কেনায় কওসরের সঙ্গী ছিল কদর। অর্থ সংগ্রহ ও অস্ত্র-বিস্ফোরক পাঠানোর দায়িত্বেও ছিল সে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে যে বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়েছিল ২০১৪ সালের অক্টোবরে, তাতে নিহত নানুরেরই কাফেরপুর গ্রামের আব্দুল করিমের সঙ্গেও কদরের ঘনিষ্ঠতা ছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কদরের বাবা রহমত কাজী ছিলেন দিনমজুর। বছর পনেরো আগে তিনি মারা যান। তাঁর সাত সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে কদর। গ্রামেই তিন মেয়ের বিয়ে দেন রহমত। বাকি তিন মেয়েকে বর্ধমানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পাঠান। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসায় থাকাকালীন দুই মৌলবীর সঙ্গে রহমতের দুই মেয়ের বিয়ে হয়। আর এক মেয়ে লক্ষ্মী ওরফে জিন্নাতুরের সঙ্গে বিয়ে হয় বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিনের নেতা কওসরের। সেই সূত্রেই কওসরের সঙ্গে কদরের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে বলে এনআইএ জানতে পারে।
পুলিশ সূত্রের খবর, খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের পরে ওই বাড়ি থেকে ধৃত রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে জেরা করে সিআইডি কওসরের শ্বশুরবাড়ির কথা জানতে পেরেছিল। এর পরেই নিমড়ায় কদরের বাড়ি যায় রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল এসআইবি (সাবসিডিয়ারি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো)। তদন্তে মিলেছিল কিছু পোড়া কাগজ, আরবি নথি ও একটি অপটিকক্যাল ফাইবারের কেবলের টুকরো। কদরের মা শরিফা বিবি অবশ্য এসআইবি-র কাছে দাবি করেছিলেন, জামাই কওসরকে তিনি চেনেন না।
এ দিন নিমড়া গিয়ে কয়েক জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করেনি কদর। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসেবে কাজ করত। পরে নিজেই রাজমিস্ত্রি হয়। চেন্নাই, মুম্বইয়েও ওই কাজ করতে গিয়েছিল। গ্রামে ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত কদর নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়ত, রোজাও রাখত। বর্ধমানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় যাতায়াত ছিল। সেই সূত্রেই শিমুলিয়ার মাদ্রায় গিয়ে কওসরের সঙ্গে আলাপ হয় কদরের। গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, কওসরের সঙ্গে লক্ষ্মীর বিয়ের পরেই কদরের হালচাল বদলাতে শুরু করে। রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দেয়। কোনও জায়গা থেকে তার হাতে প্রচুর নগদ টাকা আসতে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সে অর্থসাহায্য করতে শুরু করে। তাতে গ্রামবাসীদের একাংশের মধ্যে তার সম্পর্কে ধার্মিক এবং সমাজসেবী হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। সেই ধারণা আজও যে নেই, তা নয়।
মঙ্গলবার কদরের গ্রেফতার হওয়ার খবর শোনার পরে প্রতিবেশী জালালউদ্দিন শেখ এবং শেখ নজরুল বলেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না কদরের মতো এক জন ধর্মভীরু ছেলে ওই রকম একটা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।’’ কদরের দিদিরা কেউ মন্তব্য করতে চাননি। মা শরিফা বিবি বলেন, ‘‘এনআইএ ফোন করে কদরের গ্রেফতারির খবর জানিয়েছে। বিস্ফোরণের পর থেকে ছেলের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। তাই ও কী করেছে না করেছে, বলতে পারব না।’’
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে খবর, ২০১৮ সালে কদরের বাড়ির পাশাপাশি এসআইবি দলের সদস্যরা তল্লাশি চালান কীর্ণাহার কাজী মার্কেটের মালিক শুকুর শেখের বাড়িতেও। শুকুরের ছেলে আমজাদ ওরফে কাজলের সঙ্গে কদরের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এনআইএ আমজাদকে গ্রেফতারও করে। পরবর্তী কালে আরও কয়েক জনকে ওই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়। তাদের সঙ্গেও কদরের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে। কিন্তু, তখনও কদরের হদিস মেলেনি। তাকে গ্রেফতারের পরে জানা গেল রাজমিস্ত্রি হিসাবে সে কাজ করছিল আরামবাগে।