আঁতুড়ের আঁধারেই হারিয়ে যাচ্ছে ওরা

সদ্যোজাতকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মায়ের হাসিমুখ— ছবিটা ধাক্কা খাচ্ছে, গাঁ-গঞ্জের আঁতুড়ঘরে। কখনও মায়ের চোখ-ভাসা কান্না আবার কখনও জন্মেই সদ্যোজাতের সঙ্গে দেখাই হচ্ছে না মায়ের।

Advertisement

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও শুভাশিস সৈয়দ

কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৬ ০০:৩২
Share:

সদ্যোজাতকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মায়ের হাসিমুখ— ছবিটা ধাক্কা খাচ্ছে, গাঁ-গঞ্জের আঁতুড়ঘরে।

Advertisement

কখনও মায়ের চোখ-ভাসা কান্না আবার কখনও জন্মেই সদ্যোজাতের সঙ্গে দেখাই হচ্ছে না মায়ের।

কারণ, প্রশাসনের হাজারো সচেতনতা প্রচার সত্ত্বেও এখনও হাসপাতালমুখো হচ্ছে না বহু পরিবার। জন্ম হচ্ছে বাড়ির আটপৌরে কখনও বা নিতান্তই অস্বাস্থ্যকর আঁতুড়ঘরে। আর সেই সময়ে প্রসবের জটিলতায় কখনও মা কখনও বা তাঁর সন্তান মারা যাচ্ছেন।

Advertisement

নদিয়া জেলায় এখনও প্রায় ২.৫ শতাংশ প্রসূতি বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় পরিসংখ্যানটা আরও বেশি— বাড়িতে প্রসব হচ্ছে অন্তত ৯.৮ শতাংশ প্রসূতির।

স্বাস্থ্য দফতরের ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী নদিয়া জেলায় ৬৪০৮৫টি শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্ম নিয়েছে। আর বাড়িতে জন্ম নিয়েছে ১৭৮৫টি শিশু। মুর্শিদাবাদ জেলায় গত চার বছরে তুলনায় হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ঠিকই। তবে নদিয়া জেলার থেকে পিছিয়ে তারা। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে জুন মাস পর্যন্ত হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা ২২৬৪৩টি। এবং ২৪৬২ প্রসূতির বাড়িতে প্রসব হয়েছে। তাঁরা হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাননি।

নদিয়া জেলা স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরের জেলায় নাকাশিপাড়া ব্লকে সব থেকে বেশি প্রসূতি বাড়িতে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সংখ্যাটা ৩১২। তালিকায় তার পরেই রয়েছে নবদ্বীপ। এই ব্লকে ২০১টি শিশুর জন্ম হয়েছে বাড়িতে। জেলা সদর কৃষ্ণনগর ১ ব্লকেও ১৬৯টি সন্তান বাড়িতে প্রসব হয়েছে।

আবার মুর্শিদাবাদে হাসপাতালে না যাওয়ার প্রবণতা বেশি সমশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, সুতি, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা, সাগরদিঘি, বেলডাঙা, খড়গ্রাম এলাকায়। তার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে সমশেরগঞ্জ। ৬০৪ জনের প্রসব হয়েছে। তার পরেই ফরাক্কায় ৫৩১ জন। সুতি-২ ৩২৩, রঘুনাথগঞ্জ-২ ২২৮, সুতি-১ ১৫৮, লালগোলায় ৯৭, সাগরদিঘি ৮৭, বেলডাঙা ৬৫, খড়গ্রাম ৫৬, রঘুনাথগঞ্জে ৫৫ জনের বাড়িতে প্রসব হয়েছে।

পিছিয়ে থাকা এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে রয়েছে ভগবানগোলা-১ ব্লক। মাত্র এক জন মায়ের সন্ধান মিলেছে, যাঁর বাড়িতে প্রসব হয়েছে। যার ফলে (সরকারি হিসেব বলছে ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে) সারা জেলায় মা হতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৭১ জন মহিলার। তা ছাড়াও, ৯৩১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৮৪৭টি নবজাতক (২৮ দিন বয়স পর্যন্ত)।

কিন্তু এত আশাকর্মী থেকে শুরু করে এএনএম থাকা সত্ত্বেও প্রসূতিরা কেন হাসপাতালমুখি হচ্ছেন না?

স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, নদিয়া জেলায় বেশ কয়েকটি চর এবং সীমান্ত ঘেঁষা জনপদ রয়েছে। ভৌগোলিক কারণেই ওই সব এলাকা থেকে প্রসূতিরা হাসপাতালমুখি হতে চান না। তা ছাড়া এখনও নদিয়াতে প্রায় ৫২০টি আশাকর্মীর পদ শূন্য রয়েছে। ফলে ওই সব এলাকায় সচেতনতার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে তাঁরা জানেনই না হাসপাতালে প্রসবরে প্রশ্নে কোনও খরচই নেই।

নবদ্বীপের বাহিরচড়া এলাকার কথাই যেমন ধরা যাক। স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এখান থেকে নবদ্বীপ হাসপাতাল কিংবা কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের উপরে। রাস্তা খারাপ হওয়ার জন্য গাড়ি ঢুকতে খুব সমস্যা হয়।’’ তেমনই চাকদহের চরজাজিরার মতো জেলার বেশ কিছু চর এলাকা রয়েছে। ওই সব এলাকায় যাতায়াতের সমস্যা রয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তা আর তার সঙ্গে গাড়িঘোড়ার অভাব। ফলে ওই সব এলাকা থেকেও প্রসূতিরা আর হাসপাতাল পর্যন্ত আসতে চায় না।

যদিও নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায়ের দাবি, “২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে জেলায় প্রায় ৪ শতাংশ প্রসূতি বাড়িতে সন্তান প্রসব করেছেন। ২০১৫-১৬ বছরে কিন্তু সংখ্যাটা অনেক কম। প্রায় ২.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আশাকর্মীর শূন্য পদ পূরণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। দেখবেন, অচিরেই সমস্যা মিটবে।”

মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা একটু অন্য রকম। মুসলিম অধ্যুষিত জেলায় এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেখানে প্রসূতি মহিলারা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুরুষ চিকিৎসক রয়েছেন বলে যেতে চান না। সেই সঙ্গে জেলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং ভৌগোলিক অবস্থান বাড়িতে সন্তান প্রসবের প্রবণতার জন্য অনেকাংশে দায়ি বলে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের মত।

তাঁদের কথায়, ‘‘এমন অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে প্রসূতি মায়েদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অসুবিধের মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় আবার বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র এত দূর যে, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই বাড়িতে প্রসব হয়ে যায়।

জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভাশিস সাহা বলেন, ‘‘জেলাশাসক ওযাই রত্নাকর রাওয়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও নজরদারির ফলেই ৬৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে।’’

আর, রত্নাকর বলছেন, ‘‘এক জন প্রসূতিরও যেন বাড়িতে প্রসব না হয়, সে জন্য জেলাপ্রশাসন বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। তার মধ্যে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কল সেন্টার তৈরি করা হবে। ওই কল সেন্টারে প্রসূতি মায়েদের সমস্ত তথ্য থাকবে। প্রসবের সম্ভাব্য সময়ের আগে ফোন করে সেই প্রসূতির বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করা হবে।’’

সে সবই অবশ্য পরিকল্পনা। তার বাস্তবায়নের দিকেই তাকিয়ে মুর্শিদাবাদ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement