Bangla Awas Yojana

আবাস তালিকায় ‘গরিব’ নেতা, যোগ্যেরা অসহায়

উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর গ্রামের বাসিন্দা, বছর চল্লিশের কৌশল্যা মণ্ডল থাকেন নদীর ধারে মাটির বাড়িতে। স্বামী নেই। নিজেই দিনমজুরি করে দুই নাবালক ছেলেমেয়ে ও শাশুড়ির সংসার টানেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:০৮
Share:

(বাঁ দিকে) দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাঘডাঙায় তৃণমূলের নেতার বাড়ি। তাঁর নাম আছে আবাস তালিকায়। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ২ ব্লকের ধ্বজমাটির এই গৃহস্থের নাম আবাস তালিকায় নেই (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

ওঁদের কারও পাকা বাড়ি নেই।

Advertisement

কারও টালি ছাওয়া দরমার ঘর, কারও ঘর চাটাইয়ের বেড়ায় ঘেরা। কারও মাটির ঘরের মাথায় অ্যাসবেস্টস বা আলকাতরার পোঁচ দেওয়া টিনের চাল। কিন্তু শত চেষ্টাতেও আবাস প্লাসের তালিকায় ওঁদের নাম ওঠেনি।

অথচ ওঁদের গাঁয়েই শাসক দলের নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠদের তালিকায় নাম উঠেছে বলে অভিযোগ। দোতলা পাকা বাড়ি ছেড়ে কাছেই কুঁড়েঘর তুলে বা গোয়ালে বিছানা পেতে তাঁরা ‘গরিব’ সেজেছেন, দাবি স্থানীয়দের। সরকারি সমীক্ষক দল তালিকা হাতে এসে তাঁদের ‘দুরবস্থা’ দেখে যাচ্ছেন। সব নিয়েই রাজ্যের বহু জায়গায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ হচ্ছে, কিন্তু সুরাহা বিশেষ কিছু হচ্ছে না।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর গ্রামের বাসিন্দা, বছর চল্লিশের কৌশল্যা মণ্ডল থাকেন নদীর ধারে মাটির বাড়িতে। স্বামী নেই। নিজেই দিনমজুরি করে দুই নাবালক ছেলেমেয়ে ও শাশুড়ির সংসার টানেন। তালিকায় তাঁর নাম নেই, অথচ তৃণমূলের বুথ সভাপতি কানাই বর্মণের নাম আছে। তবে কানাই দাবি করেছেন যে, “যখন তালিকা হয়েছিল, তখন আমার মাটির বাড়ি ছিল। এখন কষ্ট করে ঘর করেছি।”

টিনের চালের ঝুপড়িতে বসবাস নদিয়ার শুকপুকুরের দিনমজুর মোস্তারিন মণ্ডলের। আবাস প্লাসের প্রথম তালিকায় তাঁর নাম ছিল, পরে বাদ গিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, “যাদের নাম তালিকায় রয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই পাকা বাড়ি আছে। অনেকে আবার গত বারই ঘরের টাকা পেয়েছে। এরা হয় তৃণমূল করে, অথবা নেতাদের টাকা দিয়ে তালিকায় নাম তুলিয়েছে।”

মণিমালা মিদ্যের কাঁচা বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৌসুনি দ্বীপের কুসুমতলায়। বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আবাস যোজনার তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। অথচ পাকা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের দুই বুথ সভাপতি বাঘডাঙার রতন মণ্ডল এবং কুসুমতলার বংশীবিহারী মণ্ডলের নাম তালিকায় রয়েছে বলে অভিযোগ। রতনের স্ত্রী পঞ্চমী মণ্ডলের ব্যাখ্যা, “আমরা কাঁচা বাড়িতেই থাকি। পাশে পাকা বাড়িতে আমার ছেলে থাকে।” বংশীবিহারীর বক্তব্য, “আমরা খুব গরিব। ওই পাকা বাড়ি আমার দাদার।”

তালিকায় নাম তুলতে চেয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রশাসনের কাছে হত্যে দিচ্ছেন মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ২ ব্লকের বালিগ্রাম পঞ্চায়েতের ধ্বজমাটি গ্রামের পঁয়ত্রিশ ঘর বাসিন্দা। আবেদনপত্রের সঙ্গে নিজেদের কাঁচা ঘরের ছবিও পাঠিয়েছেন তাঁরা। গ্রামেরই যুব তৃণমূল নেতা মহম্মদ মুরাদ হোসেন বলছেন, “এঁদের বাদ দিয়ে যাঁদের নাম তোলা হয়েছে, অধিকাংশেরই পাকা বাড়ি রয়েছে। দলের নেতাদের বললে তাঁরা প্রশাসনের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। এটা অত্যন্ত লজ্জার।”

সব যে সমীক্ষকদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, এমনটাও নয়। পুরুলিয়া ২ ব্লকের বেশ কিছু পাকা বাড়ির মালিক পাশে কাঁচা বাড়িতে খাট-বিছানা পেতেছিলেন। পুরুলিয়া ১ ব্লকের ডিমডিহা ও গাড়াফুসড় পঞ্চায়েতে আবার ‘গরিবের কুঁড়ে’ হয়েছে গোয়ালঘর। পূর্ব মেদিনীপুরেও একই ছবি। তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত পটাশপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি স্বপন মাইতি কবুল করছেন যে, “ছেলের পাকা বাড়িতে থাকেন এমন অনেক প্রবীণ ঘরের টাকা পেতে ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছেন।”

এমন জালিয়াতি ধরা পড়ছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে বঞ্চনার তালিকা আরও দীর্ঘ।

পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসায় বিদবিহার পঞ্চায়েতের বাগানপাড়ার বাসিন্দা দিনমজুর হিরু বাগদির একচালা মাটির ঘর। খড়ের ছাউনি, চারদিকে ফাটল, বাইরে থেকে খুঁটির ঠেকা দেওয়া। ঝড় হলে বাড়ি দুলে ওঠে। তালিকায় নাম ওঠেনি। হুগলির গোঘাট ২ ব্লকের মান্দারন পঞ্চায়েতের শকুনজলা ও বকুলতলা বুথ মিলিয়ে প্রায় ৮০টি পরিবারের ভাঙা ঘরেই বসবাস। এক জনেরও নাম ওঠেনি। সে খেজুর পাতার চাটাই বোনা বৃদ্ধা আসেমা খাতুন হোন বা শাড়িতে চুমকি বসানোর কাজ করা রূপসোনা। প্রথম জনের বাঁশের খুঁটি ভরসা, দ্বিতীয় জনের ছিটেবেড়া।

জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া করলাভ্যালি চা বাগান ও তার লাগোয়া এলাকায় প্রায় কোনও লাইনের শ্রমিকদের তালিকায় নাম নেই। বোয়ালমারি নন্দনপুর এলাকায় তাঁতিপাড়া, ঠকপাড়া, বোদাপাড়া, বানিয়াপাড়া এবং তিস্তার চর— এই পাঁচটি গ্রামের প্রায় পাঁচশো পরিবারের কারও নাম তালিকায় ওঠেনি।

ফলে ব্লক অফিসে বিক্ষোভ, পথ অবরোধ, পঞ্চায়েতে তালা ঝোলানো— সবই হচ্ছে। উত্তর দিনাজপুরে রায়গঞ্জ ও করণদিঘির বিভিন্ন এলাকায় সমীক্ষক দলের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অনেকে। মালদহের চাঁচলে সমীক্ষক দলের কর্মীদের ঘেরাও করেছেন বঞ্চিতেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশাসন জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের সমীক্ষার ভিত্তিতে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তার বাইরে নতুন নাম যোগ করার উপায় নেই। তবে কেউ চাইলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আবেদন করতে পারেন।

প্রশ্ন হল, ২০১৮ সালের সমীক্ষাতেও যে হাজার-হাজার যোগ্য প্রাপকের নাম বাদ গিয়েছিল, তার দায় কে নেবে? (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement