নবদ্বীপের একটি মন্দিরে কীর্তনের আসর। —নিজস্ব চিত্র।
বসন্ত এসেছে এখন বৈষ্ণবতীর্থ নবদ্বীপে। জ্যোৎস্নায় থইথই সমাজবাড়ির রাধারমণ বাগ প্রাঙ্গণে আবির কুমকুম, গোলাপজল, ধূপের গন্ধের সঙ্গেই শোনা যাচ্ছে কীর্তনের আসর থেকে ভেসে আসা জয়জয়ন্তীর সুর। কানে আসছে চেনা মহাজন পদ ‘বৃষভানুকুমারী নন্দকুমার’। সাদা মার্বেল মোড়া বিরাট নাটমন্দিরে এক দিকের উঁচু বেদিতে রুপোর সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি গোলাপে গোলাপে ঢাকা। শোনা যাচ্ছে কীর্তনের পদ, “নিরখত বয়ান নয়ন পিচকারি, প্রেম গুলাব মন হি মন লাগ। দুহুঁ অঙ্গ পরিমল চুয়া চন্দন ফাগু। রঙ্গ তহি নব অনুরাগ।” তার আখর, “তখন নয়ন পিচকারি হল, অনুরাগের রঙে ভরা নয়ন পিচকারি হল।” মৃদঙ্গ দ্বিগুণ থেকে চৌগুণে। আপ্লুত শ্রোতাদের সাধুবাদে, মুহুর্মুহু উলুধ্বনিতে ডুবে গেল সুর। বিগ্রহের সামনে রাখা পাত্র থেকে মুঠো মুঠো আবির উড়তে লাগল। বসন্ত আওল রে।
বৈষ্ণবদের ভজন কুঠিরে বসন্ত এ ভাবেই আসে। মাঘের শ্রীপঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই বসন্তোৎসবের সূচনা হয় নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরগুলিতে। তারপর ফাল্গুনি পূর্ণিমা পার করে সেই চৈত্র পূর্ণিমার রাতে বসন্ত রাসে তার সমাপ্তি। প্রায় দু’মাস ধরে চলে এই সাড়ম্বর বৈষ্ণবীয় বসন্তোৎসব। যার অন্যতম প্রধান অঙ্গ বসন্তকীর্তন। বসন্ত ঋতুতে এবং প্রধানত বসন্ত রাগে গাওয়া হয়, তাই এমন নামকরণ। পরিচিত কীর্তন থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের বসন্ত এই বিশেষ কীর্তনের সুর ছাড়া ভাবাই যায় না।
সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “বৈষ্ণবদের কাছে বসন্ত মানে এক দিকে যেমন শ্রীকৃষ্ণের হোরি বা দোললীলা, অন্য দিকে তেমনই চৈতন্যদেবের জন্মোৎসবও। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব একই সময়ে উদ্যাপন করা হয়। আর বৈষ্ণব উৎসব মানেই সুর ও বাণীর যুগলবন্দী। মহাজন পদকর্তারা সুপ্রাচীন কাল থেকে বসন্তোৎসবের জন্য রচনা করেছেন অসামান্য সব পদাবলি। পাশাপাশি চৈতন্য পরবর্তী যুগে মূলত নরোত্তম দাস ঠাকুরের হাত ধরে এল চৈতন্য বিষয়ক পদ, যেগুলি হোরি কীর্তনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠল।”
নামী কীর্তনীয়া সরস্বতী দাস বলেন, “কোনও বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে যে কীর্তন গাওয়া হয়, তাকে বলে পরব কীর্তন। বসন্তকীর্তনও হল তেমনই এক ধরনের পরবকীর্তন। এই কীর্তন প্রধানত বসন্ত রাগে গাওয়া হয় এবং অবশ্যই বসন্তকালে, দোলের আগে পরে।” শুভেন্দুবাবু জানান, গরানহাটির খেতুরিতে নরোত্তম দাসের মহোৎসব থেকে কীর্তনের যে গরানহাটি ধারা তৈরি হয়, সেখানে তিনি বসন্তকীর্তন বা হোরিকীর্তনের জন্য যেমন বসন্ত, জয়জয়ন্তী, শ্রী, গুর্জরী বা কেদারের মতো ঋতুপ্রধান রাগের ব্যবহার করেছেন, তেমনই তালের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ছন্দ প্রধান চটুল তাল যাতে একটা মাতন বা দোলা আছে। তিনি বলেন, “সাত মাত্রার চঞ্চুপুট তালের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন হোরি তাল, ধামার তাল প্রভৃতি। সবই করা হয়েছে বসন্তকীর্তনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে।”
কীর্তন নিয়ে দেশ বিদেশ চষে বেড়ানো কীর্তনীয়া সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “জয়দেব থেকে বাসুদেব ঘোষ, গোবিন্দদাসের মতো পদকর্তাদের পদে বসন্ত একটা আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। ফলে বসন্তকীর্তন খুব সমৃদ্ধ। কথা এবং সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। ‘শিশিরক অন্তে আওয়ে বসন্ত, ফুল্ল কুসুমসব কানন অন্ত’--গোবিন্দদাসের এই পদটিকে বসন্তের আগমনী ধরা হয়। অন্য দিকে, ‘আওত রে ঋতুরাজ বসন্ত, খেলত রাই কানু গুনবন্ত, তরুকুল মুকুলিত অলিকুল ধাব, মদনোমহোৎসবে পিককুল রাব’ জ্ঞানদাস রচিত এই পদটি নিশ্চিত ভাবেই রাধাকৃষ্ণের বসন্তোৎসবের উদ্বোধনী। এই সব পদ ছাড়া বসন্তকীর্তন ভাবাই যায় না।”
সুমনবাবু জানান, কীর্তনে শুদ্ধ বসন্ত রাগে কীর্তন গাইতে হয়। তা ছাড়া হিন্দোল বা সকালের দিকে গুর্জরী, বিকেলের দিকে গৌরী, দেশবরাড়ি রাগেও গাওয়া হয়। এমনকী অবিরল রঙের ধারাস্নান বর্ষার আবেশ আনে বলে বসন্তকীর্তনে মল্লারও ব্যবহার হয়। বৈষ্ণবেরা এ ব্যাপারে খুবই সতর্কও। যেমন মহাপ্রভুর আরতি কীর্তনের বিখ্যাত পদ‘ভালি গোরাচাঁদের আরতি বনি’ শ্রীপঞ্চমী থেকে চৈত্রপূর্ণিমা পর্যন্ত বসন্ত রাগে গাওয়া হয়। বসন্ত বিদায় নিলেই সুরও যায় বদলে।
নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সভাপতি এবং চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, “এখনও সমাজবাড়িতে পুরো সময় ধরে নিখুঁত ভাবে বসন্তোৎসব পালন করা হয়। অন্যত্র একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত উদযাপন হয়। একাদশীর দিন অভিসার, দ্বাদশীর দিন আবির খেলা, ত্রয়োদশীর দিন গোলাপজলে রঙ খেলা, চতুর্দশীর দিনও রঙ খেলার সঙ্গে নানা রসপ্রসঙ্গ এবং পূর্ণিমার দিন হোরিখেলা শেষ হয় রাস নৃত্যে। প্রতিদিনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কীর্তন।” কীর্তন রসভারতী সরস্বতী দাস সেই কৃষ্ণ, চৈতন্য লীলাপ্রসঙ্গে তাঁর ভজনকুটীরে গেয়ে ওঠেন, আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা প্রিয় আমার ওগো প্রিয়।