শান্তিপুরের লেবুতলাপাড়ায় নালার নোংরা জল জমে থাকে এ ভাবেই।
দিনটা ছিল ১৮ অক্টোবর, ১৮৯৭। শান্তিপুরের কমিশনার যশোদানন্দ প্রামাণিকের বাড়ির সামনের নর্দমায় আটকে যেত নিকাশি জল। তিনি নিজেই সেই নর্দমা পরিষ্কার করে খরচ বাবদ ৮ আনা দাবি করে পুরসভার বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুরসভা সেই মামলা লড়ার জন্য ১০ টাকা অনুমোদন করে।
পুরসভার কার্য বিবরণীতে উল্লিখিত শান্তিপুরের নিকাশি ব্যবস্থার সে দিনের সেই ছবি আজও বিশেষ বদলায়নি। শহরের বাসিন্দারা এখন বিদ্রুপ করে বলেন, “বর্ষার দরকার নেই। মেঘ ডাকলেই ভেসে যায় আমাদের শহর।” অথচ এই শহরের নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করছে পুরসভা। কিন্তু তারপরেও শহরের নিকাশি এমন বেহাল কেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরের বাসিন্দারা। পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে এমন বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে প্রায় সারা বছরই কমবেশি জল জমে থাকে। আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই। জল থইথই এলাকাগুলি শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জমে থাকা নোংরা জল মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় পুরনাগরিকদের। জল ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতরেও।
সম্প্রতি এমনই করুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে লেবুতলা এলাকার বাসিন্দাদের। ওই এলাকায় একটি বড়সড় কাঁচা নর্দমা থাকলেও সেই নর্দমার জল বের হওয়ার কোনও পথ নেই। একটি পুকুরের উপর দিয়ে সেই জল বের করে দেওয়া হত। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকার ফলে এই মুহূর্তে ওই পুকুরে নর্দমার জল ফেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ দিকে জল বেরনোর পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নর্দমার সেই পচা জল উপচে আশপাশের বাড়িতে উঠে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দা কমল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “আমরা যে মানুষ সেটাই বোধহয় সকলে ভুলে গিয়েছে। এত দিন বর্ষাকালে বাড়িতে জল উঠত। এখন দেখছি শীত কালেও রেহাই নেই।”
শুধু লেবুতলা এলাকাতেই নয়, দাদদেপাড়া, হামিদিয়া লেন, ছুতোর পাড়া, নিকারিপাড়া, রথতলা, চৌগাছাপাড়া, শ্যামচাঁদ রোড, রাধাকৃষ্ণপল্লি, বিনয় বাদল দিনেশ পল্লি, সূত্রাগড়ের খুদেকালী তলা, ভেড়িপাড়া লেন, গর্তকলোনী, কিনু মুন্সি লেন, বাঁশতলা পাড়া, শিবদুর্গা কলোনি, আগমেশ্বরী মন্দিরের উল্টো দিকে সর্বনন্দিপাড়া-সহ একাধিক এলাকার অবস্থাও তথৈবচ। সামান্য বৃষ্টিতেই এই সব এলাকায় নর্দমা উপচে পড়া জল ঢুকে পড়ে বাড়ির মধ্যে। এখানে যে নিকাশি ব্যবস্থা নেই তা কিন্তু নয়, বরং পুরসভার উদ্যোগে স্থানীয় কাউন্সিলরদের পরামর্শে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নর্দমা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।
বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীন এই শান্তিপুর পুরসভা তৈরি হয়েছিল ১৮৬৫ সালে। তারপর দীর্ঘ দিন ধরে এই পুসভায় ক্ষমতায় থেকেছে বামপন্থীরা। ১৯৯০ সাল থেকে টানা পুরপ্রধানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তৃণমূলের অজয় দে। ফলে এই শহরের উন্নতিসাধনের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল দুই পক্ষের হাতেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন তা হল না? শুধুই কি সদিচ্ছার অভাব নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে? পুরসভার বিরোধী দলনেতা সোমেন মাহাতো বলছেন, “নিকাশির কাজ যে একেবারে হয়নি তা বলা যাবে না। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে অপরিকল্পিত ভাবে। ওয়ার্ড ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ভাবে নালা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পুরসভার নিজস্ব কোনও পরিকল্পনা না থাকায় সে সব কিছুই মানুষের কাজে এল না। এর ফলে শহরের নিকাশি সমস্যার কোনও সমাধান তো হলই না, বরং মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ল।”
বিরোধীদের দাবি, এই শহরের চার দিকে ভাগীরথী বা সুরধনী নদী ছাড়াও একাধিক খাল রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু বড় জলাশয়ও। আগে যখন সে ভাবে এই শহরে নিকাশি-নর্দমা তৈরি হয়নি তখন প্রাকৃতিক ভাবেই বর্ষার জল এই সব জলাশয়, নদী-খাল ও নিচু এলাকায় গিয়ে পড়ত। তাতে শহরে তেমন জল জমত না। এখন একের পর এক জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে দোকান, বাড়ি। ফলে শহরের নিজস্ব প্রাকৃতিক নিকাশি ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তার উপরে কৃত্রিম ভাবে তৈরি নর্দমা বা হাইড্রেনগুলিও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি না হওয়ার কারণেই শহরের নিকাশি ব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থা।
শহরের প্রধান ও প্রাচীনতম হাইড্রেনটি হল কে সি দাস ড্রেন। শহরের ভিতর দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই ড্রেনটি গোভাগাড় থেকে শুরু হয়ে বড়বাজার রথতলা, মালোপাড়া হয়ে কলাবাগানের কাছে খালে মিশেছে। এটাই শহরের আদি নিকাশি ব্যবস্থা। পরে একে একে বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় নর্দমা তৈরি করে এই ড্রেনে এনে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এই ড্রেনটি অন্য ড্রেন থেকে উঁচু হওয়ায় বর্ষার জল এই ড্রেনে এসে পড়ার পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জল উল্টো চাপ দেয়। ফলে বর্ষার জল বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি করে ভাসিয়ে দেয় ওই সব এলাকা। এছাড়াও খালগুলির গভীরতাও কমতে থাকায় বর্ষার জল সেখানেও উপচে পড়ে।
কে সি দাস রোডে নালার জল উঠে এসেছে রাস্তায়।
পুরসভা এই ড্রেন ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কেয়েকটি বড় বড় নর্দমা তৈরি করেছে। তৈরি হয়েছে মাটির নীচে দু’টি আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেন। তাতে একটা বড় এলাকায় সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও সর্বিক অবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি। এর বাইরেও পুরসভা শহরের ভিতরে চারটি বড় পুকুর কিনেছে। সেখানেই শহরের বিভিন্ন এলাকার জল ফেলা হচ্ছে। পুরপ্রধান অজয় দে বলেন, “১৯৯০ সালের আগে এই শহরে নিকাশি ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। আমরাই ধাপে ধাপে আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করার চেষ্টা করছি। প্রাচীন এই শহর পুরোপুরি অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে। ফলে নিকাশি ব্যবস্থার হালও প্রথম থেকেই খারাপ।”
তাহলে এই শহরের সার্বিক নিকাশি ব্যবস্থার জন্য সমীক্ষা করে একটা মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে না কেন? বছর চল্লিশ আগে পুরসভার সিপিএমের কাউন্সিলর ছিলেন মানিক বিশ্বাস। তিনি বলেন, “আমাদের সময়ে ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে সার্ভে করিয়ে একটা মাস্টার প্লান তৈরি করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, সেই মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ধাপে ধাপে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে বর্তমান পুরবোর্ড সেটার ব্যবহার করল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল। নিকাশি ব্যবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে গেল।”
যদিও অজয়বাবুর দাবি, “আমরা এমন কোনও মাস্টার প্ল্যানের কথা জানি না। আমরা নিজেরাই একবার অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিলাম। তবে নানা কারণে সেটা বাস্তবায়িত হয়ে ওঠেনি।”
আদৌ কোনওদিন হবে তো? উত্তর জানা নেই শান্তিপুরের।
সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১