সেজে উঠেছে পদ্মাপাড়। কাছারিপাড়ায় কল্লোল প্রামাণিকের তোলা ছবি।
একসময় কত নামেই না তাকে ডাকা হত-- রাক্ষসী, মুখপুড়ি, সর্বগ্রাসী। আর ডাকবে নাই বা কেন! মাঠ, ঘাট, দালানকোঠা সবই তো তলিয়ে গিয়েছে তার গর্ভে। কালের স্রোতে পদ্মা এখন শান্ত। তার দু’পাশে জেগে উঠেছে চর। আর সেই জেগে ওঠা চিকচিকে চরকে ঘিরেই আশায় বুক বাঁধছে সীমান্তের গ্রাম, কাছারিপাড়া। টলটলে নদীর জল, পাখপাখালির ডাক আর সবুজে ঘেরা সেই চরে ‘পিকনিক স্পট’ করে স্বনির্ভর হতে চাইছে একসময়ের সর্বহারা, সীমান্তের ওই গ্রাম।
জেগে ওঠা চরের বিঘে ছয়েক জমিকে নেট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রয়েছে নানা ধরনের গাছপালা। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বসার জায়গা। উপরে খড়ের ছাউনি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা। ওপারে চরের মাঠ। তারপরেই বাংলাদেশ। টিনের চাল দেওয়া বাড়িগুলো ঠিক ছবির মতো।
এমন পিকনিক স্পটের খবর সীমান্তের গ্রামে গ্রামে রটে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শীতের মিঠে রোদ্দুরে ইতিমধ্যে সেখানে ভিড়ও জমছে। পদ্মাপাড়ে দিনভর হইহই করে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় গুনতে হচ্ছে সাকুল্যে দশ টাকা! গ্রামেরই যুবক সন্তোষ জোয়ারদারের মাথায় ভাবনাটা প্রথম আসে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। সঙ্গে জুটে যায় গ্রামের আরও কয়েকজন। বিএসএফ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা মাসকয়েক আগে থেকে কাজও শুরু করে দেন পুরোদমে।
সন্তোষবাবু বলছেন, “প্রথমে তো অনেকে বিশ্বাসই করতে চাননি। তারপরে সকলের মিলিত চেষ্টায়, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পদ্মাপাড় এ ভাবে সাজিয়ে তুলেছি। প্রাথমিক ভাবে অস্থায়ী শৌচাগার, ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। সেগুলোও করব। আমাদের সঙ্গে গোটা গ্রাম রয়েছে যে।”
সন্তোষবাবুর দাবি, “আগামী দিনে এখান থেকেই গ্রামের অনেকের কর্মসংস্থান হবে। এই স্পটটি সাজিয়ে তুলতে কাজ করছেন গ্রামের শ্রমিকরাই। পিকনিক করতে আসা লোকজন সবকিছুই যাতে হাতের কাছে পেয়ে যান সে ব্যবস্থাও আমরা করব। সব্জি, পানীয় জল, রান্নার সরঞ্জাম থেকে শুরু করে পিকনিকের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করবেন গ্রামের ছেলেরাই।”
ইতিমধ্যে যাঁরা পিকনিক করতে এসেছিলেন তাঁরা কিন্তু এমন জায়গা দেখে বেজায় খুশি। কুপিলার বাবর আলি, করিমপুরের রমেন বিশ্বাসদের কথায়, “কাছাকাছি পিকনিক করার জায়গা বলতে সেই লালবাগ। ফলে বাড়ির কাছে এমন একটা জায়গায় পিকনিক করতে পারা মানে সবদিক থেকেই ভাল। এমন অসাধারণ পরিবেশের কোনও তুলনা নেই।”
পিকনিক করতে আসা লোকজনের এমন প্রতিক্রিয়া শুনে কাছারিপাড়ার মনে পড়ে যাচ্ছে বছর পনেরো-কুড়ি আগের সেই ভাঙনের দিনরাত্রির কথা। “ওই, ওই যে দেখছেন, চারাগাছটা যেখানে মাথা তুলেছে, ঠিক তার পাশেই আমাদের প্রায় ত্রিশ বিঘা জমি ছিল। আর ওই যেখানে জলটা পাক খাচ্ছে, সেখানে ছিল আমাদের বাড়ি। সব পদ্মায় তলিয়ে গেল। আচমকা জীবনটাই বদলে গেল। এখন অন্যের জমিতে ভাগচাষ করে পেট চালাতে হচ্ছে।” বলছেন সত্তর বছরের ফটিক মণ্ডল।
ফটিকবাবু একা নন, কাছারিপাড়ার বিপদ সরকার, নীরেন সরকার, শঙ্কর মণ্ডলেরা এখনও পদ্মার পাড়ে এসে দাঁড়ালে স্পষ্ট মনে করতে পারেন ঠিক কোথায় ছিল তাঁদের বাড়ি, নিকানো উঠোন, বাঁধানো তুলসিতলা। কেউ আবার ভাল ভাবে বোঝাতে ছোট একটুকরো ঢিল সাঁ করে পদ্মার জলে ছুড়ে দিয়ে বলেন, “ওইখানে ছিল আমাদের গোয়ালঘর। জানেন, হাজার চেষ্টা করেও গরুগুলোকেবাঁচাতে পারিনি।”
করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্করবাবু বলেন, “সে বড় সুখের সময় ছিল না। রোজদিনই কিছু না কিছু ভাঙছে। কত লোক গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। যারা থেকে গেল তারাও নতুন করে জীবনযুদ্ধ শুরু করল। টানা পাঁচ বছর ধরে চলা সেই ভাঙনের ধাক্কায় গোটা গ্রামের মেরুদণ্ডটাই যেন ভেঙে গিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারপর কত কিছু বদলে গেল। পদ্মা শান্ত হয়ে গেল। জেগে উঠতে শুরু করল চরের জমি। আর হারানো সেই জমিকে আঁকড়ে এই আকালেও আমরা যদি স্বপ্ন দেখি, আশা করি পদ্মা বিমুখ হবে না।”
ওই হার না মানা যুবকদের স্বপ্ন পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে প্রশাসনও। করিমপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির বন ও ভূমি দফতরের কর্মাধ্যক্ষ প্রসেনজিৎ বিশ্বাস বলেন, “ওই চরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঘাটতি না থাকলেও রাস্তা, পানীয় জল, শৌচাগারের সমস্যা আছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি সেগুলি কাটিয়ে তোলার।” করিমপুর ১ বিডিও তাপস মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইতিমধ্যে ওই পার্কের জন্য একটি নলকূপের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। শৌচাগার ও রাস্তার বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি।”