পাপাই ও আলিফ। নিজস্ব চিত্র
বন্ধুত্বটা সেই পঞ্চম শ্রেণি থেকে। বারো ক্লাশের পরে পেশার টানে ছিটকে গেলেও পারস্পারিক টান যে রয়ে গিয়েছিল, হায়দরাবাদ থেকে এসে রক্ত দিয়ে তারই কিছুটা জানান দিয়ে গেলেন আলিফ মালিত্যা।
আলিফ অবশ্য একা নন। এক্কেবারে না-চেনা মুখের জন্যও যে কোভিড আবহে সব সংস্কার ফেলে হাসপাতালে ছুটে আসা যায় শ্যামনগরের সেলিম শেখ দেখিয়ে গেলেন তা-ও।
চেনা আর অচেনা মুখের সেই পুরনো এবং নতুন বন্ধুত্বে ফের এক বার সেরে ওঠার চেষ্টা শুরু করলেন পাপাই মণ্ডল। পাপাইয়ের সঙ্গে আলিফের বন্ধুত্ব সেই গ্রাম-জীবনের। এক পুকুরে সাঁতার থেকে দুই সম্প্রদায়ের উৎসবে দু’জনেরই মেতে ওঠা থেকে যার শুরু। নওদার গোঘাটা গ্রামের সেই হারানো দিনগুলো শুক্রবার শনিবার ফের ঝলমল করে উঠল কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে। গোঘাটার আঠাশ বছরের পাপাইয়ের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে একমাত্র রোজগেরে পাপাই যে এমন নিভে আসছেন তা আলিফ জানতেন না। ফেসবুকে খবরটা চোখে পড়তেই আর দেরি করেননি।
রক্তের গ্রুপও তারও এ-নেগেটিভ। রক্তাল্পতায় ভোগা জেলার ব্লাডব্যাঙ্কে সে রক্ত না থাকায় পাপাইকে দিন কয়েক আগে রেফার করে দেওয়া হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু কোভিড ছায়ায় সে হাসপাতালেও রক্তের আকাল। ফেসবুকে তা জানতে পেরেই ৮ সেপ্টেম্বর স্পেশ্যাল ট্রেনে চড়ে বসেছিলেন আলিফ। তার পর কলকাতায় পৌঁছে সটান এনআরএসে গিয়ে পাপাইয়ের জন্য রক্ত দিয়ে এসেছেন তিনি। নওদা থানার ওসি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন শ্যামনগরের সেলিমের সঙ্গে। দ্বিধা-জড়তা ফেলে তিনিও না-চেনা পাপাইয়ের জন্য রক্ত দিয়ে এসেছেন।
গত তিন সপ্তাহ আগে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন পাপাই। আমতলা গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসার পর জানা গিয়েছিল, তাঁর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নেমে এসেছে ৩.৫%-এ। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ক’দিন চিকিৎসার পরে তাঁকে রেফার করে দেওয়া হয়েছিল এনআরএস হাসপাতালে। কিন্তু সপ্তাহখানেকের চিকিৎসায় আর যাই হোক রক্ত মেলেনি। নওদা থানার ওসি মৃণাল সিংহ সক্রিয় হয়ে যোগাযোগ করেছিলেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সলংগঠনের সঙ্গে। শ্যামনগর থেকে নিজের খরচে কলকাতায় এসে পাপাইকে রক্ত দিয়ে যান সেলিম শেখ ও বাসুদেব হালদার। আর আলিফ বলছেন, ‘‘এক সঙ্গো হুটোপুটি করেছি, তার জন্য এক ইউনিট রক্ত দেব না,
হয় নাকি!’’
পাপাইয়ের মা রানিদেবী বলছেন, ‘‘এখনও দেবদূত আছে বাবা, তাঁর কোনও জাত-ধর্ম হয়না। আলিফ-সেলিম-বাসুদেবকে দেখে তাই মনে হল!’’