শুকিয়ে যাচ্ছে জল।
সে এক সময় ছিল বটে!
সম্পন্ন গৃহস্থের থাকত গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু। চাষির থাকত সুঠাম হাল, নধর বলদ। আর মৎস্যজীবীর হরেক কিসিমের জাল, ডিঙি ছাড়াও ছিল অফুরান জল। শুকিয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চাঁদেরপাড়ার শঙ্কর হালদার ম্লান হাসছেন, ‘‘সেই অফুরান জলও চোখের সামনে কেমন ফুরিয়ে গেল, দেখুন! খাল, বিল, ডোবার কথা ছেড়েই দিন, নদী পর্যন্ত জল বিনে মরে যাচ্ছে।’’
একই সঙ্গে শুকিয়ে যাচ্ছে মৎস্যজীবীদের ভবিষ্যৎও। যাঁরা খেলাচ্ছলে বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন খাল-বিল-নদী-নালায়, সেই তাঁরাই এক দিন বাঁচার জন্য বেঁচে নিলেন পূর্বপুরুষের পথ। ভাসতে ভাসতেই জলকে ভালবেসে ফেললেন। জলের দিব্যি দিয়ে বইতে থাকল নিশ্চিন্ত জীবনও।
কিন্তু সেই জলজ-জীবনেও এক দিন জেগে উঠল অনিশ্চয়তার চর। শুরু হল দখলদারিদের তাণ্ডব। টলটলে বিল ভাগ হতে হতে ডোবায় পরিণত হল। ভরাট পুকুরের উপরে মাথা তুলে দাঁড়াল ইমারত। শীর্ণ নদীতে মাটি ফেলে তৈরি হল পথ। জলঙ্গির মৎস্যজীবী অবিনাশ মণ্ডল বলছেন, ‘‘জল-স্থল সব একাকার হয়ে গেল। কোথাও কোথাও এমন অবস্থা হয়েছে যে, কাছে গিয়েও বোঝার উপায় থাকে না, সেটা নদী নাকি খেত!’’
সেই নদী-খেতেই চাষ হয়, ফসল ফলে। নদীপথেই ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছোটো। এমনকি বহু মৎস্যজীবী সেই পথ দিয়েই যেতে যেতে চোখের জল মুছে হাঁক দেন, ‘‘টিন ভাঙা... লোহা ভাঙা, বেচবেন গো...।’’ ডোমকলের ইমরান শেখ বলছেন, ‘‘জীবনে কখনও ভাবিনি, এই মাঝবয়সে এসে অন্য কাজ করতে হবে। তবুও পেটের দায় বড় দায়। যে হাতে জাল টানতাম, সেই হাতেই এখন ভাঙাচোরা লোহা, টিন ওজন করছি।’’
ডোমকলের বহু জেলেপাড়ার সেই চেনা ছবিটাও এখন তাই বেমালুম বদলে গিয়েছে। মাছের ঝুড়ির বদলে মৎস্যজীবীর সাইকেলে উঠে গিয়েছে হরেক জিনিসের ঝুড়ি। দাওয়ায় পড়ে থাকা জালটা কবে ইঁদুরে কেটে দিয়েছে। ডাঙায় পড়ে থাকতে থাকতে নৌকার অর্ধেক মাটিতে ঢেকেছে। যাঁরা এ সব সইতে পারেননি, তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে।
রানিনগর ১ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি আমিনুল হাসান বলছেন, ‘‘আমরাও নদীর পাড়ে বড় হয়েছি। চোখের সামনে বছর কয়েকের মধ্যেই ছবিটা বদলে গেল।’’