তৃণমূল নেতা মতিরুল বিশ্বাসের বাইকের পাশ থেকে উদ্ধার হয়েছে মেয়ের জন্য কেনা সেই পুতুল। নিজস্ব ছবি।
ছেলে মুর্শিদাবাদের মহম্মদপুর আল-আমিন মিশনে থেকে পড়াশোনা করে। মাকে ফোন করে সে নারকেল নাড়ু খেতে চেয়েছিল। সেই মতো মা-ও হাজার ব্যস্ততার মধ্যে ছেলের জন্য নাড়ু তৈরি করে বাবার হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেকে নাড়ু দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বাবা। ফেরার পথে ছোট্ট মেয়ের জন্য একটি পুতুল আর স্ত্রীর জন্য একটি কাচের গ্লাসের সেটও কিনেছিলেন তিনি। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। গাড়ি জলঙ্গির ফেরিঘাটের কাছে পৌঁছতেই আচমকা তিন-তিনটি বোমাবর্ষণ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলেন তিনি। পালানোরও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। পিছন থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে পর পর তিনটি গুলিতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নদিয়ার তৃণমূল নেতা মতিরুল বিশ্বাস (৪৫)।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুর্শিদাবাদের নওদার শিবনগর এলাকায় খুন হন নদিয়ার নারায়ণপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রিনা বিশ্বাসের স্বামী মতিরুল। তিনি নিজেও করিমপুর-২ ব্লকের তৃণমূল সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি। দুষ্কৃতী-হামলার পর রাস্তাতেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়েছিলেন মতিরুল। খবর পেয়ে পরে নওদা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাঁকে আমতলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই মৃত্যু হয় নদিয়ার থানারপাড়া থানার সাদিপুরের বাসিন্দা মতিরুলের।
তৃণমূল নেতা খুনের খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই থমথমে নওদা ও সাদিপুর দুই এলাকা। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের উচ্চৃপদস্থ পুলিশকর্তারা। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত সুপার কৃশানু রায় বলেন, ‘‘তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে একটি সূত্র ধরে তদন্ত চলছে।’’ মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সুরিন্দর সিংহও বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে খুন বলে মনে হচ্ছে। তিনটি সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে আততায়ীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, মাঝেমধ্যেই ছেলে আরিফকে দেখতে আল-আমিন মিশনে আসতেন মতিরুল। অনুমান, দুষ্কৃতীরা তা জানতেন। সেই মতোই হামলার ছক কষা হয়। পরিবারের দাবি, অতীতেও মতিরুলকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেই কারণে জেলা পুলিশ তাঁর নিরাপত্তার জন্য এক জন কনস্টেবল ও এক সিভিক ভলান্টিয়ার নিযুক্ত করে। ঘটনার সময় তাঁরাও মতিরুলের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতীদের হামলার মুখে তাঁরা কেন পাল্টা গুলি চালাল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন স্ত্রী রিনা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ বলছে, দু’জন দুষ্কৃতী মোটরবাইকে এসে কাছ থেকে স্বামীকে গুলি করেছে। বডিগার্ড ছিল তো। উনি কেন আত্মরক্ষায় গুলি চালালেন না?’’ পুলিশ সূত্রে খবর, দুষ্কৃতীরা বোমা ছোড়ার পর ওই নিরাপত্তারক্ষী টিয়াকাটা ঘাটের দিকে ছুটে যান। ঘটনার ঘণ্টা তিনেক পর ওই নিরাপত্তারক্ষীকেই সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় থানারপাড়া থানার পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে খবর, ২০২১ সালে ১ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকায় একটি ইটভাটার মালিকানার স্বত্ব কেনেন মতিরুল-সহ পাঁচ জন। তা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই নদিয়া জেলা পরিষদের সদস্য টিনা ভৌমিকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত রাজকুমার কবিরাজ, পিঙ্কু মণ্ডল এবং মুর্শিদাবাদের সাংসদ আবু তাহের খানের ভাগ্নে হাবিবের সঙ্গে তাঁর বিবাদ চলছিল। ইটভাটা মালিক মনিরুল শেখের অভিযোগ, ‘‘রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হাবিব ও রাজকুমার ইটভাটা জবরদখল করেন। কার্যত বাধ্য হয়ে মতিরুল ভাটার মালিকানা ছেড়ে দেন।’’ অভিযোগ, মালিকানা হস্তান্তর না হলেও ন’মাস ধরে ইটভাটা দখল করে আছেন রাজকুমার এবং পিঙ্কু। বার বার অভিযোগ জানালেও পুলিশ এ ব্যাপারে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করেনি।
মৃতের আত্মীয়দের দাবি, দলের গোষ্ঠী কোন্দলের জেরেই মতিরুলকে খুন করা হয়েছে। নদিয়া জেলা পরিষদের সদস্য টিনা ভৌমিক, রাজকুমার এবং নওদার ব্লক তৃণমূল সভাপতি সফিউজ্জামান শেখের যোগসাজশে মতিরুল খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ। রিনা বলেন, ‘‘টিনা ও হাবিব একসঙ্গে পরিকল্পনা করে খুন করে আমার স্বামীকে খুন করেছে।’’ তেহট্টের তৃণমূল বিধায়ক তাপস সাহারও অভিযোগ, ‘‘টিনা ভৌমিক দীর্ঘ দিন ধরে মতিরুল ও মিঠুকে খুনের চক্রান্ত করছে। ইটভাটা-সহ বেশ কিছু চাষের জমি অবৈধ ভাবে কব্জা করে রেখেছেন টিনা। অবিলম্বে ওকে গ্রেফতার করার দাবি জানাচ্ছি।’’
ঘটনায় নাম জড়িয়েছে সাংসদ আবু তাহেরের ভাগ্নেরও। তার প্রেক্ষিতে সাংসদ বলেন, ‘‘হাবিব কলকাতায় আছে। এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কারও নাম করা হচ্ছে। খুনের ঘটনায় যে বা যারা জড়িত প্রকৃত তদন্ত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করুক পুলিশ। যদি খুনের পিছনে দলের কেউ জড়িত থাকে, দলও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। পুলিশকে বলা হয়েছে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে।’’ টিনাও বলেন, ‘‘কে কী অভিযোগ করল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা কিসের ভিত্তিতে অভিযোগ করছেন?’’