মারিশদায় দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সেই গাড়ি। নিজস্ব চিত্র
ক্ষয়াটে লুঙ্গি, কুঁচকে যাওয়া কামিজ আর ‘গামছাটা সঙ্গে দিস’— ছোট্ট এই আবদারটাই যে তাঁর শেষ কথা হয়ে মোবাইলে উড়ে আসবে, কালাম শেখের পরিবারের কেউ ভাবতে পারেননি। গোকর্নের হাটপাড়ার বাড়ির সামনে এলোমেলো ভিড়ে হাঁটুতে মাথা ঠুকে কাঁদার মাঝে এ কথাটাই বার বার বলে চলেছেন ছোট মেয়ে আরজেমা। বলছেন, ‘‘যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না বাবার, দলের নেতাদের কথা ফেলতে পারল না, চাপে পড়েই চেপে বসল গাড়িতে...আর ফিরল না!’’
দলের চাপেই দিঘা পাড়ি দেওয়ার কথাটা ঘুরে ফিরে আসছে পুরন্দরপুরের বাড়িটার অন্দর থেকেও। অসিত দাসের স্ত্রী সাগরিকা বলছেন, ‘‘কত করে বললাম, ‘কি এমন মধু আছে গো, যে হুট করে আমাদের না নিয়েই চললে!’’ সেই আক্ষেপটা যে এমন তিরের মতো বিঁধে থাকবে, ভাবতেই পারেননি।
গোকর্ণ থেকে পুরন্দরপুর, হাটপাড়া কিংবা তিলিপাড়ার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কান্দির গ্রাম জুড়ে এমনই টুকরো হা-হুতাশে ভারী হয়ে আছে আষাঢ়ের আকাশ। কোথাও অনিচ্ছা নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আক্ষেপ কোথাও ঘরের বাড়া খাবার খেতে না ফেরার যন্ত্রণা।
দিঘার পথে, দুর্ঘটনার পরে দুমড়ে প্রায় অচেনা হয়ে যাওয়া তৃণমূল নেতা-কর্মীদের যে বোলেরো গাড়িটা কেড়ে নিয়েছে ৬ জনের প্রাণ, বুধবার তাঁদের বাড়ি ঘুরে দেখা গিয়েছে এমনই অজস্র অনুযোগ-অভিযোগের ভিড়। কোথাও তা উপচে পড়া কান্না, কোথাও বা শুধুই শুকনো চোখে তাকিয়ে থাকা।
বছর চারেক আগে বিয়ে হয়েছিল গাড়ির চালক প্রদীপ দাসের। তাঁর পরিবারের লোকজন জানান, যাওয়ার কথা ছিল ভবানীপুরের হায়দার আলির ভাই আমজাদ আলির বোলেরো গাড়ির। কিন্তু সে গাড়ির এসি খারাপ থাকায় প্রদীপকেই পাড়ি দিতে হয়। প্রদীপের মা রীনা বলেন, ‘‘মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিঘা যাওয়ার কথা আমাকে জানায়। আমি বলি গঙ্গাস্নান করে সাবধানে যা। আমায় বলল, ‘মা গঙ্গা নয় সমুদ্রে স্নান করব!’’ যা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকলেন স্ত্রী পাপিয়া। না, কোনও কথা নেই তাঁর মুখে। সমরনাথ ঘষের বাড়িতে পা রাখতেই অস্বস্তি শুরু হল, স্ত্রী সুচিত্রা ঘোষ ঠাকুর ঘরে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছেন। তাঁকে জল পর্যন্ত খাওয়াতে পারেননি কেউ। এ দিকে ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে আশির কোঠায় তাঁর বৃদ্ধা মা শিবানি ঘোষ কেঁদে চলেছেন এক টানা। মুখে একটাই কথা, ‘‘কার যাওয়ার কথা আর কে গেল!’’
হায়দার আলি’র স্ত্রী মঞ্জিরা বেগমও চুপ করে গিয়েছেন। বলছেন, ‘‘গাড়ি বের করতে পারছিল না চালক। তখনই মনে খটকা লাগল। তার পরে মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। তখনই ঘুম ভেঙে তাঁকে ফোন করে ‘গাড়ি ধীরে চালানোর’ কথা বলি। পাল্টা শুনলাম, ‘চিন্তা করো না’, নাহ, আর চিন্তা করব না।!’’