সাবিত্রীবাই, বিদ্যাসাগরই বা কিসে কম যান?

কুম্ভীলকবৃত্তির জন্য যিনি আদালতে অভিযুক্ত হয়েও রক্ষা পান, সেই সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনকে এই প্রজন্ম আদর্শ শিক্ষক বলে বিবেচনা করবে কেন? লিখছেন দেবোত্তম চক্রবর্তীতাই সংবৎসর অতীব অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা ছবি ঝাড়পোঁছ, চন্দনচর্চিত ও মাল্যশোভিত করে হয় রাধাকৃষ্ণণ পুজো।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share:

—ফাইল চিত্র।

বাঙালি চিরকালের আমোদগেঁড়ে জাতি। যা হোক একটা অছিলা বের করে ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’-এ সে পরম পারঙ্গম। ইদানীং সেই তালিকায় নতুন আবির্ভাব শিক্ষক দিবসের। ভাদ্র মাসে ব্যবসাদারদের ভাটার বাজারে জোয়ার এনে দিয়েছে তা। যে শিক্ষক যত ‘দামি’, তাঁর জন্য বরাদ্দ তত দামি উপহার। সে সব কিনতে গিয়ে এমনকি মফস্‌সলের রাস্তাতেও জ্যামজমাট পরিস্থিতি। বিনিময়ে শিক্ষকদের ‘টোল’-এ দিনভর দেদার হুল্লোড় আর অনন্ত আমোদের উপকরণ— কোথাও বা ভরপেট বিরিয়ানি, আবার কোথাও রেস্তোরাঁ বুক করে পছন্দসই খাবারের অঢেল আয়োজন। সব মিলিয়ে ‘রাখিস মা রসেবশে’ পরিবেশ।

Advertisement

সে এক দিন ছিল, যখন শিক্ষকের মলিন পোশাক এবং শতচ্ছিন্ন ছাতাটির দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল ‘সমাজ গড়ার কারিগর’-এর উষ্ণীষ। কিন্তু হায়! তে হি নো দিবসা গতাঃ। বর্তমানে বেতন তুলনামূলক কিছুটা ভদ্রস্থ হতেই সেই সামাজিক গরিমা হারিয়ে আপাতত তাঁরা শ্রেণিশত্রুতে পরিণত।

তবুও আনুষ্ঠানিকতা বড় বালাই। তাই সংবৎসর অতীব অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা ছবি ঝাড়পোঁছ, চন্দনচর্চিত ও মাল্যশোভিত করে হয় রাধাকৃষ্ণণ পুজো। শিক্ষকেরা বছরের পর বছর কতিপয় অনিচ্ছুক শ্রোতার সামনে অবিরল অবিশ্রান্ত ভাবে মন্ত্রোচ্চারণের মতো আউড়ে চলেন তিরুতান্নির এই ব্রাহ্মণের জীবনী। কেউ ভুলেও দেশের শিক্ষাপ্রসার বা সংস্কারে তাঁর অবদান কিংবা তিনি স্বতন্ত্র কোনও দর্শনতত্ত্বের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্নও তোলেন না। কিন্তু যাঁর বিরুদ্ধে ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি’র জন্য ১৯২২ সালে যদুনাথ সিংহের জমা দেওয়া গবেষণাপত্র ‘Indian Psychology of Perception, Vol. I & II’ থেকে অনেকটা অংশ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত নিজের ‘Indian Philosophy Vol. II’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ ওঠে; কুম্ভীলকবৃত্তির জন্য আদালতে অভিযুক্ত হন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বদান্যতায় কোনও ক্রমে রক্ষা পান, তাঁকে এই প্রজন্ম আদর্শ শিক্ষক বিবেচনা করবে কেন?

Advertisement

শিক্ষা সংস্কারে মনোযোগী, স্বীয় উদ্যোগে বহু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের স্থপতি, ‘বর্ণপরিচয়’-এর লেখক বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে কি শিক্ষক দিবস পালিত হতে পারত না? অবশ্য তাতেও যে আপত্তি একেবারে উঠবে না, তা নয়। অনেকে বলতেই পারেন — বিদ্যাসাগর কেবল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ভর্তি করেছিলেন; বালিকাদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষিকা-শিক্ষণ বিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন; প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের সরকারি প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন; তিনি তো আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না!

১৮৪৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে যিনি মেয়েদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন, সেই সাবিত্রীবাই জ্যোতিরাও ফুলের জন্মদিনও তো শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হতে পারে। বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে অতি কষ্টে কায়স্থ ছাত্রদের প্রবেশাধিকার দিচ্ছেন এবং সুবর্ণবণিক ছাত্র ভর্তি করতে না পেরে আক্ষেপ করছেন, তখন সাবিত্রীবাইয়ের নেটিভ ফিমেল স্কুল গমগম করছে ‘অস্পৃশ্য’ মাং, মাহার, মাতং ছাত্রীতে। তবে চুনী কোটাল কিংবা রোহিত ভেমুলার কথা মাথায় রেখে এক জন ‘ফুলে’ মানে জাতিতে মালি অর্থাৎ ‘দলিত’ মহিলাকে শিক্ষকদের ‘আইকন’ না বানানোই বোধ হয় শ্রেয়!তার পর রবীন্দ্রনাথ, যিনি শিক্ষাকে ‘কেবলমাত্র কঠিন শুষ্ক অত্যাবশ্যক পাঠ্যপুস্তকেই নিবদ্ধ’ না রেখে ‘তাহাদের চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তি’-কে পুষ্ট ও পরিণত করতে চান; যিনি স্কুলের বন্দিশালার অচলায়তনকে ভেঙে স্থাপন করেন শান্তিনিকেতনের সচলায়তন; যিনি প্রায় সত্তর বছর বয়সে কলম ধরেন ‘সহজ পাঠ’-এর জন্য; তাঁকে আদর্শ শিক্ষক হিসাবে বিবেচনা করাই যায়। কিন্তু ‘ইস্কুল-পালানে’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে টানাটানি করা কি ঠিক হবে?

বরং শিক্ষক দিবসটাই উঠিয়ে দেওয়া যাক। বছরের বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন জগ ছুড়ে শিক্ষিকার থুতনি ফাটিয়ে দেওয়া গেলে, নকল করতে গিয়ে বাধা পেয়ে স্কুলের চেয়ার-বেঞ্চ ভেঙে চুরমার করা গেলে, দিদিমণিদের পোশাক নিয়ে ফতোয়া দেওয়া গেলে, শুধু একটা দিন বেচারা ‘শিক্ষকদের’ মুখে ‘আচার্যদেবো ভব’-র লবেঞ্চুস গুঁজে দেওয়ার অকারণ আদিখ্যেতা এ বার বন্ধ হোক। “সকল লোকের মাঝে ব’সে/ আমার নিজের মুদ্রাদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা?” বোধহয়, তা নয়। রাস্তাঘাটে পথচলতি যত শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা হবে আপনার, আমার স্থির বিশ্বাস, তাঁদের অনেকেই এই কথাগুলোই বলবেন। হয়তো অতিরিক্ত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের এই বাক্যটাও বলে উঠতে পারেন স্বগতোক্তির ঢঙে: “যাহা স্বাভাবিক নহে তাহাকে প্রমাণ করিতে হইলে লোকে অধিক চীৎকার করিতে থাকে — এ কথা ভুলিয়া যায় যে, মৃদুস্বরে যে বেসুর ধরা পড়ে না চীৎকারে তাহা চার-গুণ হইয়া উঠে।”

শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement