টেট-এর ফর্ম তুলতে নাকাল আবেদনকারীরা, চলল লাঠিও

টাকার বিনিময়ে ‘স্পট বুকিং’ কৃষ্ণনগরে

রাতভর লাইনের একেবার সামনের দিকে বসেছিল হলুদ টি-শার্ট পড়া ছেলেটি। রাতে সকলের সঙ্গে গানের লড়াইতেও মেতেছিল সে। সকালবেলা তাঁকে আর দেখা গেল না! তাঁর পরিবর্তে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ঝকঝকে চেহারার এক যুবতী। তাঁর চোখে মুখে ক্লান্তির কোনও ছাপ নেই। স্নানের পরে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল দেখে বোঝাই যায় রাতজাগা হাজারটা মুখের ভিড়ে সে বড় বেমানান।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:৫০
Share:

টেটের ফর্ম তুলতে লম্বা লাইন। রঘুনাথগঞ্জে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

রাতভর লাইনের একেবার সামনের দিকে বসেছিল হলুদ টি-শার্ট পড়া ছেলেটি। রাতে সকলের সঙ্গে গানের লড়াইতেও মেতেছিল সে। সকালবেলা তাঁকে আর দেখা গেল না! তাঁর পরিবর্তে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ঝকঝকে চেহারার এক যুবতী। তাঁর চোখে মুখে ক্লান্তির কোনও ছাপ নেই। স্নানের পরে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল দেখে বোঝাই যায় রাতজাগা হাজারটা মুখের ভিড়ে সে বড় বেমানান।

Advertisement

ব্যাপারটা কি?

আর কিছুই নয়— ‘স্পট বুকিং’। টেটের লাইনে পয়সার বিনিময়ে রীতিমতো বিক্রি হল জায়গা! কৃষ্ণনগরের পাত্রবাজারের মুখে এক ব্যাঙ্কের শাখায় সামনে দীর্ঘ লাইনে সেই দর ঘোরাফেরা করল সাতশো থেকে হাজারে। ওই যুবতীর স্বীকারোক্তি, ‘‘দাদা, হাজার টাকা চেয়েছিল। অনেক বলে কয়ে সাতশো টাকায় রাজি করিয়েছি।’’ কী ভবে আলাপ হল দাদার সঙ্গে? তাঁর কথায়, ‘‘ওঁকে চিনতাম না। আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল। দাদাই টাকার বিনিময়ে লাইন ধরে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। রাতভর অপেক্ষার ঝক্কি এড়াতে রাজি হয়ে যাই।’’ সেটা একেবারে মুখের কথায় হয়নি। অর্ধেক টাকা দিয়ে ‘বুক’ করতে হয়েছিল। সকালে জায়গা মেলার পরে বাকিটা। ওই লাইনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কালীগঞ্জের এক যুবক। তাঁকেও ওই ‘সাধু’ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি অবশ্য সে সুবিধে নিতে পারেননি। ধরা গলায় বলেন, ‘‘টিউশনি করে পড়ার খরচ চালাই। তার উপরে ফর্ম তুলতে এসে প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ করে ফেলেছি। ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হল কই? অন্যদের সঙ্গে রাত জেগে মশার কামড় খেলাম।’’

Advertisement

প্রাথমিকে টেট-এর ফর্ম তোলা নিয়ে দুর্ভোগের শেষ রইল না শুক্রবারও। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ— দুই জেলাতেই নাকাল হলেন আবেদনকারীরা। কোথাও দীর্ঘ লাইন, কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই ‘আজ আর ফর্ম মিলবে না’ এমন ঘোষণার পরে শুরু হল অশান্তি। চলল পুলিশের লাঠিও।

ফর্ম তোলার লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অন্তত ২০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন রানাঘাটে। ১৬ জনকে রানাঘাট হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। ফর্ম তুলতে এসে শ্রাবণী দাস নামে এক প্রার্থী তড়িদাহত হন। লম্বা লাইনে ঠেলাঠেলির সময়ে রাস্তার পাশের একটি দোকানের বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের সুপার শ্যামলকান্তি পোড়ে বলেন, ‘‘গরমের জন্য এবং সময় মতো খাওয়া-দাওয়া না হওয়ায় ওরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারও অবস্থা গুরুতর নয়।’’

কৃষ্ণনগরের পরে বহরমপুরেও লাঠি চালাল পুলিশ। শহরের প্রাণকেন্দ্র গ্রান্টহল মোড় লাগোয়া ব্যাঙ্কে ফর্ম শেষ হয়ে যায় দুপুর সোওয়া তিনটে নাগাদ। তখনও লম্বা লাইন ছিল চারশো মিটার দূরের গির্জার মোড় পর্যন্ত। ফর্ম শেষ শুনে আবেদনকারীদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। ঢিল ছুঁড়ে ভাঙা হয় ব্যাঙ্কের জানলার কাচ, ব্যাঙ্কের নাম লেখা গ্লোসাইন বোর্ড। পুলিশ তিন দফা লাঠি চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। লাইনের অপেক্ষমান আবেদনকারীদের পরে টোকেন দেওয়া হয়। ওই টোকেন দেখিয়ে আজ, শনিবার তাঁরা ফর্ম তুলতে পারবেন।

মুর্শিদাবাদে মোট ৬টি শাখা থেকে ফর্ম দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও বহরমপুর পঞ্চাননতলার মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কাউন্সিলের কার্যালয় থেকেও ফর্ম বিলি করা হচ্ছে। মুর্শিদাবাদ জেলা লিড ব্যাঙ্ক (ইউবিআই) ম্যানেজার অমিত সিহ বলেন, ‘‘জেলার জন্য ২৬ হাজার ফর্ম পাওয়া গিয়েছিল। সব শেষ। ফের ফর্ম দেওয়ার জন্য জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কাউন্সিলের সভাপতির কাছে অনুরোধ করেছি।’’ কাউন্সিলের সভাপতি দেবাশিস বৈশ্য জানান, কলকাতা থেকে ফর্ম আসছে। শনিবার সকাল ১০টার আগে ব্যাঙ্কে ফর্ম পৌঁছে যাবে। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার অর্ধ দিবসের পরে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও যাঁরা ফর্ম নিতে চাইবেন, তাঁদের জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কাউন্সিলের কার্যালয় থেকে ফর্ম দেওয়া হবে।’’

রঘুনাথগঞ্জ-সহ মুর্শিদাবাদের সব মহকুমা শহরেই প্রতিদিনই উপচে পড়ছে আবেদনকারীদের ভিড়়। শুক্রবার ভিড়ের চাপে ছেলে ও মেয়েদের দুটি আলাদা লাইন রঘুনাথগঞ্জে প্রায় ৫০০ মিটার ছাড়িয়ে যায়। বৃহস্পতিবারের ফর্ম না পেয়ে বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধের কথা মাথায় রেখে এ দিন ব্যাঙ্কের সামনে ব্যাপক পুলিশ ও সিভিক কর্মী মোতায়েন করা হয়। শুক্রবার রঘুনাথগঞ্জে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তা দিয়ে যান চলাচল সকাল থেকেই বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধক রাজীব গোস্বামী বলেন, ‘‘ফর্ম বণ্টনের দায়িত্ব ব্যাঙ্কের নয়। ফর্মের দাম বাবদ ১০০ টাকা করে নির্দিষ্ট চালানে ব্যাঙ্কে জমা নেওয়ার পর ব্যাঙ্কে বসেই ফর্ম দিচ্ছেন জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের প্রতিনিধিরা।’’ গোলমালটা কোথায়? তাঁর উত্তর, ‘‘লাইনে দাঁড়ানো এক একজন যুবক এক সঙ্গে তিন-চারটি করে ফর্ম তুলে নিচ্ছেন। তার ফলেই দ্রুত ফর্ম ফুরিয়ে যাচ্ছে।’’

বৃহস্পতিবার রঘুনাথগঞ্জে বিকেল পাঁচটার সময় ফর্ম না পাওয়া প্রায় সাড়ে আটশো প্রার্থীকে ব্যাঙ্ক থেকে টোকেন দিয়ে বিক্ষোভ সামাল দেওয়া হয়। শুক্রবার ফর্ম তুলতে তাঁরা তো হাজির ছিলেনই, সঙ্গে ছিল হাজার কয়েক নতুন আবেদনকারীর দীর্ঘ লাইন। জেলাজুড়েই এই ছবি চোখে পড়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত আজ, শনিবার ফর্ম বিক্রির শেষ দিন। বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে রঘুনাথগঞ্জে ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়েছিলেন লালগোলা ও ফরাক্কার অর্জুনপুরের জনা ১৫ যুবক। ব্যাঙ্কের সামনে গভীর রাতে জনা পনেরো যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাত পাহারায় থাকা পুলিশের টহলদারি ভ্যান দাঁড়িয়ে যায়। লাইনে দাঁড়ানো এক যুবক বলেন, ‘‘পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। পরে সকলের ছবি তোলে, নাম পরিচয় লিখে নেয়।’’ পুলিশ জানিয়েছে, ব্যাঙ্কের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement