এই যন্ত্রণার শেষ কবে? জানতে চায় বহরমপুর। বহরমপুরের পঞ্চাননতলায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
শহরের যানজট ঠেকাতে প্রশাসনিক স্তরে কম বৈঠক হয়নি। প্রতিবারই প্রশাসনের তরফে জানানো হয়, এবার সমস্যা মিটবে। রাস্তায় বেড়িয়ে আর যানজটে পড়তে হবে না। কিন্তু প্রতিশ্রুতিই সার। কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, তার প্রমাণ মেলে বহরমপুরের উত্তরপাড়া মোড় থেকে ভাকুড়ি পর্যন্ত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে নিত্যদিন গাড়ির সারিতে। ঘন্টার পরে ঘন্টা যানজটে আটকে থাকে নাগরিক জীবন।
সম্প্রতি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সারগাছির পর থেকে খাগড়া রেলগেট পর্যন্ত— প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তার সংস্কার করে। রাস্তা সংস্কার করার সময়ে যানজটের কবলে পড়তে হত সাধারণ যাত্রী থেকে নিত্যযাত্রী— সকলকেই। মানুষ ভেবেছিলেন, রাস্তা সংস্কার শেষ হওয়ার পর হয়ত যানজট থেকে রেহাই মিলবে। কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের মিল হল না। এখনও যানজট নিত্য সঙ্গী জেনেও হাতে সময় নিয়ে বাড়ি থেকে বার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
তাঁদের অভিযোগ, বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব ও পশ্চিম—দুই প্রান্তে রাস্তা দখল করে পর পর দাঁড় করানো থাকে বেসরকারি বাস। এতে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। একই ভাবে যানজট হবে জেনেই যেন পঞ্চাননতলা রেলগেটের দুই প্রান্তে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে লরি। সব রাজনৈতিক দলেরই শ্রমিক সংগঠনেই ‘সিটু’ অনুমোদিত সিন্ডিকেটের লরি রাস্তার উপরেই দাঁড় করিয়ে রাখে। পাশাপাশি রয়েছে মধুপুরের টোল আদায়। ওই রাস্তায় টোল আদায় বহরমপুর পুরসভা বেসরকারি এক সংস্থাকে বরাত দিয়েছে। ওই টোল আদায়কে কেন্দ্র করেও জীতয় সড়কের গতি থামকে থাকে।
বহরমপুর নাগরিকদের কথায়, যানজটহীন রাস্তা থাকলে স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি নাগরিক জীবনেও গতি আসবে। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘নাগরিকদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাঁরা কোনও ট্র্যাফিক আইন মানতে চান না। বিভিন্ন মোড়ের লাল-সবুজ সিগন্যালের তোয়াক্কা করেন না তাঁরা। এমনকী ট্র্যাফিক পুলিশ এক দিকের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করলে অন্য দিকের গাড়ি-মোটরবাইক-টুকটুক সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা না করে পাশাপাশি দাঁড করিয়ে মোড়ের মুখে বন্ধ করে দেয়। এতে যানজট পাকিয়ে যায়।’’
জনসংখ্যা বাড়লেও বহরমপুর শহরের বিকল্প রাস্তা হিসেবে গত কয়েক বছরে কাশিমবাজার রিং রোড, বহরমপুর কোর্ট স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তা, সারগাছি থেকে মানকরা রোড হয়ে ভাগীরথীর পাড় বরাবর তৃতীয় সড়ক ছাড়া নতুন কোনও রাস্তা নির্মিত হয়নি। এদিকে চুঁয়াপুর মোড় হয়ে বাস-লরি-ট্রেকার শহরের মধ্যে যেমন ঢুকে পড়ছে, তেমনি গির্জার মোড় হয়ে বাস ও লরি ঢুকে পড়ে শহরের বিভিন্ন মোড়ের যানজটের মাত্রা বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। একই ভাবে কৃষ্ণনাথ রোডের ধারে রাস্তা দখল মিনি ট্রাক অপারেটর্স ইউনিয়নের লরি, এলআইসি ভবনের কাছে বেসরকারি বাস ও লরি, রানিবাগান মোড়ের কাছে ওই রাস্তা-সহ বিভিন্ন গলি দখল করে ভাড়ার ট্যাক্সি সারি দিয়ে দাঁড় করানো থাকে। পুলিশ ও প্রশাসন ওই গাড়িগুলি সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগী হয় না বলেও অভিযোগ।
পুলিশের এক কর্তা জানান, নির্দেশ রয়েছে পুলিশের কারণে যেন কোনও আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয়। ফলে ওই রাস্তা দখল করে থাকা ওই গাড়িগুলি সরিয়ে ফেলতে গেলে রাজনৈতিক দলগুলিও তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা এড়াতেই সাহসী পদক্ষেপ করা যায় না।
জেলা চেম্বার অফ কমার্সের যুগ্ম সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে চুঁয়াপুরের দিক থেকে শহরের ভেতরে পণ্যবাহী লরি বা বাস চলাচল আটকানো উচিত এবং শহরের বেশ কিছু রাস্তায় যান চলাচল একমুখী করে দেওয়া হলে সুফল মিলবে। নিয়ন্ত্রণহীন টুকটুক গাড়ি চালানো নিয়েও পুরসভা ও প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ করা জরুরি।’’ বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড চত্বর-সহ সমবায়িকামুখী রাস্তা থেকে টেক্সটাইল কলেজ মোড় পর্যন্ত রাস্তা দখল করে থাকা হকারদের তুলে না দেওয়া পর্যন্ত যানজট কমবে না বলেও বহরমপুরের নাগরিকদের ভাবনা।
বহরমপুরের বিভিন্ন রাস্তার যানজটে সাধারণ নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। তার উপরে বেআইনি ভাবে রাস্তার উপরে লরি-বাস রেখে দেওয়ার ফলে ওই যানজট বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পঞ্চাননতলা মোড় ছাড়িয়ে জাতীয় সড়ক বরাবর চুঁয়াপুর পর্যন্ত এবং বহরমপুর-জলঙ্গি রাজ্য সড়কে বানজেটিয়া ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। যদিও পুলিশ ও প্রশাসন ওই যানজট নিয়ন্ত্রণে উদাসীন। সেই সুযোগে একশ্রেণির চালকও ট্র্যাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে গাড়ির লম্বা লাইনের বাইরে বেরিয়ে আগে পৌঁছাতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত যানজট তৈরি করে ফেলছে। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে পথচরী থেকে নিত্যযাত্রীদের।
ওই যানজটের কারণে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড পঞ্চাননতলা মোড় প্রায় ২ কিমি রাস্তা পার হতে ঘন্টা খানেকের বেশি সময় লাগছে এখন। তার মধ্যে লালগোলা-শিয়ালদহ শাখায় ট্রেন চলাচলের জন্য পঞ্চাননতলা রেলগেট বন্ধ হলে ওই পথে যাতায়াত নরক যন্ত্রণার সামিল। যেমন পঞ্চাননতলার দিক থেকে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে পাশাপাশি তিনটে সারি করে বেসরকারি বাসগুলি নিয়ম ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকছে প্রতি দিন। সরকারি বাসও তাতে সামিল। উল্টো দিক থেকে যান চলাচল করবে তারও উপায় নেই।
কারণ ট্র্যাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে তত ক্ষণে মোটরবাইকের ঝাঁক উল্টো দিকের মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় যানজট পেকে গিয়েছে। গির্জার মোড়ের দিক থেকে কোনও যান চলাচল করতে পারছে না। সব মিলিয়ে পণ্যবাহী লরি, বাস, ব্যাটারি চালিত টুকটুক, মোটরবাইক, রিকশা, রিকশা ভ্যান, সাইকেলের লম্বা লাইনের সারি। এমনকী পথচারীরাও যে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করবেন, তারও কোনও উপায় নেই।
এক দিকে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখের ওই জট পঞ্চাননতলা মোড় হয়ে চুঁয়াপুর মোড়ের দিকে আছড়ে পড়েছে। অন্য দিকে ওই যানজটের কারণে গির্জার মোড় হয়ে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সেতুর উপরে থেকে খাগড়া রেলগেটের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।