—ফাইল চিত্র।
বাপ-ঠাকুরদার দেওয়া একটা নাম ছিল বটে, কিন্তু তা ভুলে মেরে দিয়েছিল সকলেই। আড়ালে-আবডালে তাকে সকলেই ডাকত ‘মুম্বারি চোর’ বলে। সেটাই তার নাম বলে জানত সে নিজেও।
এই মুম্বারি নামটা অবশ্য তার পেশার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল সুতোর মতো। কোনও এক সময়ে রাঢ় অঞ্চলের হিজল এলাকার ওই যুবক কাজের সন্ধানে গিয়েছিল মুম্বাই। সেখানে কী কাজ করত, ফিরে এসে খোলসা করেনি কারও কাছে। কিন্তু হাত সাফাই করতে হয় কী ভাবে, তা রপ্ত করে এসেছিল ভাল ভাবে।
ফলে দ্বারকা নদী ঘেরা নিজের গাঁয়ে পা রাখার কিছু দিনের মধ্যেই হাতের সাফাই যশের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। শুধু নিজের গাঁ নয়, আশপাশের বেশ কয়েকটা গাঁয়ের মানুষ সে খ্যাতির কথা জানতেন।
মুম্বই ফেরত বলে তার নাম হয়ে গিয়েছিল মুম্বারি চোর। কিন্তু কে ওই বকচ্ছপ নাম রেখেছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে ছোট-বড় সকলেই তার সামনে ‘মুম্বারি’ বলে ডাকলেও একটু আড়ালে চলে গেলেই নামের সঙ্গে ‘চোর’ বিশেষণ জুড়ে দিতেন।
মুম্বারি ছিল আসলে জুতো চোর। পুজো-পরবে তার আবার কদর বেড়ে যেত। তখন সকাল ও রাতে ভিড় বাড়ত বাড়িতে। খেটে-খাওয়া ও দিনমজুর হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের মানুষজন ভিড় করতেন জুতো কেনার জন্য। তাঁরা আসতেন খালি পায়ে এবং বাড়ি থেকে ফিরে যেতেন নতুন জুতো-চপ্পল পায়ে গলিয়ে।
তবে একই পায়ের জোড়া চটি-জুতো সকলের ভাগ্যে যে জুটত, তা কিন্তু নয়। ফলে লাল ফিতের সঙ্গে নীল ফিতের চপ্পল, তো কারও পায়ে হিলের জুতো ভিন্ন রংয়ের। পুজো ও ইদের আগে খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত। সারা দিনের পরে বাড়ি ফিরে আসত বহরমপুর-কান্দি রুটের রাতের শেষ বাস ধরে। কখনও সন্ধের বাস ধরে এসে নামলেই গ্রামের মোড়ের ভিড় ছেঁকে ধরত। বাস থেকে নামতেই পিঠে ধরা বস্তার চেহারা দেখে আশপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে আসত—‘কি হে? আজ ভাল ব্যবসা হয়েছে মনে হচ্ছে!’ কেউ কেউ আবার চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে উঠে এসে জোরাজুরি করত—‘মেয়েটা কয়েক দিন ধরে জুতোর বায়না করছে। দেখাও যদি ওর পায়ের মাপের একটা কিছু পাওয়া যায়।’
মুম্বারি হেসে বলে, ‘‘আজ তো বাচ্চা ছেলেমেয়ের কিছু পাইনি । বাড়িতে এসো কাল সকালে, খুঁজে দেখব যদি কিছু থাকে।’’ মাটির বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে ডাঁই করে পড়ে থাকত হরেক কিসিমের জুতো। জুতোর সেই পাহাড় থেকে পায়ের মাপের ও একই পায়ের জোড়া জুতো খোঁজাও কিন্তু এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার! মোড়ে বাঁশের বেঞ্চে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে ইন্দ্রকে দেখে বলে, ‘‘তুমি তো মাস্টারবাড়ির ছ্যালা।
তুমি বুঝবা বুলেই বুলছি। দেখবা ব্যাটা মরার পরে আমার জন্নত হবেই হবে। কারণ আমি মন্দির-মসজিদ-গির্জায় ঘুরে বেড়াই। সকলের দুয়া (দোওয়া) আমার উপরে।’’ বলেই চুপ করে বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে মিটিমিটি হাসে।
চায়ের দোকানে বসা সকলেই যা বোঝার বুঝে গিয়ে হাসতে থাকে। ইন্দ্রও হাসতে থাকে।
ইন্দ্রের ছেলেবেলায় দেখা সেই মুম্বারি পেশায় চোর, কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে তার অদ্ভুত কদর ছিল। পরিণত বয়সে এসে ওই বৈপরীত্য কিছুতেই মেলাতে পারে না।
সেই মুম্বারি এক দিন দুপুরে বহরমপুরের লালদিঘি এলাকায় একটি পাঁচিলে ঘেরা বাড়িতে ঢুকেছিল জুতো চুরি করতে। কিন্তু বাড়ির কর্তা জেগে ছিলেন। জুতো বস্তায় ভরে পালিয়ে আসার সময়ে গ্রিলের দরজায় শব্দ পেয়ে বেরিয়ে আসেন। দেখে পাঁচিল টপকে পালানোর সময়ে মুম্বারির পা চেপে ধরেন বাড়ির কর্তা। পালানোর ফন্দি খুঁজতে আচমকা বলে ওঠে— ‘কত্তা পায়ে ফুঁড়া (ফোঁড়া)।’
সেই ফোঁড়ার কথা শুনে হাত ছেড়ে দেন বাড়ির কর্তা। সেই সুযোগে পাঁচিল টপকে পালায় সে।
ওই গল্প করে মুম্বারির জিজ্ঞাসা—বাড়ির কত্তা চিৎকার করলেই ধইর্যা ফেলত লোকে। কিন্তু ফুঁড়ার কথা শুনে তিনি হাত ছ্যাইড়া দিলেন ক্যানে আমি বুজতে (বুঝতে) পারলাম না! তবে আমি পাঁচিল টপকে পালিয়ে জান বাঁচিয়ে ছিলাম সে বার।’’
সেই কত্তার সঙ্গে মুম্বারির দেখা হয়েছিল বহরমপুরে এক ডাক্তারের চেম্বারে।
মুম্বারি নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল তাকে ছেড়ে দেওয়ার কারণ। হাসতে হাসতে সেই বাড়ির কর্তা জবাবে যা বলেছিলেন, তা হল— তাঁর পায়ে এক বার ফোঁড়া হয়েছিল। আড্ডায় হাসির একটা কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে সেই ফোঁড়ার জায়গায় হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। সেই ব্যথা তাঁর মনে থাকায় ফোঁড়ার কথা বলায় হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন।
মুম্বারি তাঁকে প্রণাম করে বাড়ির চটি ফেরত দিয়ে গিয়েছিলেন। তা ছ’মাস পরেও হলেও!