ঢাকের শব্দ কানে যেতেই রাজার চোখ জলে ভরে উঠল। খাজনা না মেটানোর দায়ে তাঁকে কারাগারে পুরেছিলেন মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব আলিবর্দি খাঁ। মুক্তি পেয়ে নদীপথে ফিরছেন, বাতাসে তখন বিজয়া দশমীর ঢাকের বোল।
সেটা সম্ভবত ১৭৪০ সাল। কথিত যে দুর্গাপুজো করতে না পারার আক্ষেপেই কৃষ্ণনগরে ফিরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তিনিই চৈতন্য পরবর্তী নদিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ফলকচিহ্ন। আর তাঁর শাসনকালেই (১৭২৮-৮২) নদিয়া সাক্ষী রইল সবচেয়ে বড় পালাবদলের। ২৩ জুন ১৭৫৭, রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন আলিবর্দির দৌহিত্র, বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আর সেই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় গাঁথা হয়ে গেল আরও একটি নাম— পলাশি।
ব্রিটিশ শাসনে কৃষ্ণচন্দ্রের ক্ষতির বদলে লাভই হল। চিরশত্রু নবাবের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে ব্রিটিশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই হয়ে পড়েছিলেন তিনি, অন্তত গোড়ার দিকটায়। তখন বেশ খানিকটা দক্ষিণে গোরাদের গড় ঘিরে কলকাতা নামে একটা নতুন জনপদ তখন সবে জন্মাচ্ছে।
কতটা বিস্তৃত ছিল তাঁর রাজত্ব? ইতিহাসের একটি সূত্র বলছে, ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশবর্ষীয় কৃষ্ণচন্দ্র যখন রাজা হচ্ছেন, তখন ৩৫ কিসমত ও ৪৯ পরগনা সমন্বিত নদিয়া রাজ্যের আয়তন ছিল ৩৮৫০ বর্গক্রোশ বা ১৫,৪০০ বর্গমাইল। আয় বছরে ২৫ লক্ষ টাকা! ১৭৪০ সালে কৃষ্ণচন্দ্রের দখলে ছিল ৩০৯১ বিঘা জমি। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় কৃষ্ণচন্দ্রের প্রভাব।
কিন্তু একদা মিত্র ইংরেজদের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্কের আমূল বদল ঘটে পরে। তত দিনে ক্ষয় শুরু হয়েছে নদিয়া রাজ্যে। দেনার দায়ে বিক্রি হচ্ছে জমিদারি। কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র বা তস্যপুত্র ইশ্বরচন্দ্রের আমলে দ্রুত ছোট হয়ে আসে রাজ্য। কিন্তু কিনছেন কে? না, সামান্য এক পান বিক্রেতা বা ‘পান্তি’! চূর্ণীতীরের এক গণ্ডগ্রাম ব্রহ্মডাঙার আসল নামটা তত দিনে লোকে ভুলতে বসেছে। একটি সূত্রের মতে, একদা সেখানে ছিল কুখ্যাত রণা বা রানা ডাকাতের ঘাঁটি। ডাকাতের উপদ্রব কমে গেলেও লোকমুখে রানার ঘাঁটি হয়ে উঠছে রানাঘাট।
সেই সময়ে দুই ভাই কৃষ্ণ আর শম্ভু পান্তি নদীপারের হাটে পানের ব্যবসা করতেন। সেটা ১৭৮০ সাল। কৃষ্ণচন্দ্র তখনও সিংহাসনে, তবে বৃদ্ধ হয়েছেন। মন্দিরের মোহান্তের পোকা-ধরা ছোলা কিনে কপাল ফিরে গেল দুই ভাইয়ের। ন’হাজার মণ ছোলা ৬১২৫ টাকায় কিনে ১৩৮৭৫ টাকায় বিক্রি করলেন তাঁরা। সেই লভ্যাংশ দিয়ে শুরু হল নানা রকম ব্যবসা। লাভের কড়ি বিস্তর জমা হতে লাগল। এ দিকে রাজস্ব বাকি পড়ায় তত দিনে কোম্পানি আইনে জমিদারি নিলাম হতে শুরু করেছে। কৃষ্ণ পান্তি শুরু করলেন সেই জমিদারি কেনা। ১৭৯৪-৯৯ সালের মধ্যে রানাঘাট-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার জমিদারি হস্তগত হল কৃষ্ণ পান্তির।
তদানীন্তন নদিয়ারাজ শিবচন্দ্র কৃষ্ণ পান্তিকে ‘চৌধুরী’ উপাধি দিলেন। আদতে ‘পাল’ পদবিধারী পান্তিরা এর পর থেকে ‘পালচৌধুরী’ হলেন। শোনা যায়, সে কালে বছরে তাঁরা ৯ লক্ষ টাকা আয় করতেন। ইতিমধ্যে নদিয়ার আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠল রানাঘাট। নদিয়া-মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব বঙ্গ থেকে পাটের চালানের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবেও ব্যাপক গুরুত্ব বাড়ল এই শহরের।
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ইংরেজরা ১৭৮৭ সালে বঙ্গদেশে নদিয়াকে প্রথম জেলা হিসাবে চিহ্নিত করে দফতর স্থাপন করে। পরে ক্রমান্বয়ে ১৭৯৩, ১৭৯৫, ১৭৯৬, ১৮৩৪, ১৮৬১ এবং ১৮৮৮ সালে নদিয়ার অঙ্গচ্ছেদ করে গঠিত হয় পার্শ্ববর্তী জেলা। ক্রমাগত ছোট হয় নদিয়া। ১৮৫৪ সালের আগে নদিয়া যশোহর ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬০ সালে কৃষ্ণনগরকে সদর করে পৃথক নদিয়া ডিভিশন গড়া হয়। পুরনো বিন্যাস ভেঙে নদিয়া জেলা গড়া হয় কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, কৃষ্ণনগর, চুয়াডাঙা, শান্তিপুর ও বনগ্রাম নিয়ে। পরে বনগ্রাম যশোহর সাব-ডিভিশনে যুক্ত হয়। আর শান্তিপুর মহকুমা বদলে যায় রানাঘাট মহকুমায়।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট পর্যন্ত এই ভাগই বহাল ছিল। দেশভাগের মূল্য চোকাতে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর আর চুয়াডাঙা চলে যায় কাঁটাতারের ও পারে, আজকের বাংলাদেশে। (শেষ)