প্রতীকী ছবি।
বছরের শেষ সোমবারে মুর্শিদাবাদের সাপ্তাহিক হাটে কেনাবেচার হাল দেখে বিস্মিত নদিয়া থেকে যাওয়া বস্ত্র ব্যবসায়ীরা। গত সপ্তাহেও যা ছিল স্বাভাবিক, এ দিন সেখানে অর্ধেকেরও কম ব্যবসা হয়েছে।
বরং ভরা শীতে উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। রাতারাতি, বাজারের এই পরিবর্তনের পিছনে ব্যবসায়ীরা করোনার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। সপ্তাহখানেক ধরে বিদেশে বিশেষ করে, চিনে করোনা সংক্রমণের খবর এবং তার জেরে এ দেশের সরকারি স্তরে নানা তৎপরতা দেখেই মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। তারই পরিণতি আচমকা ব্যবসায় পতন।
সোমবার নিজে মুর্শিদাবাদ হাটের এই চেহারা দেখে একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ফিরেছেন চাকদহ সেন্ট্রাল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক সুবল দেবনাথ। তাঁর কথায়, “গত লকডাউন বা করোনার ঢেউয়ে বিধিনিষেধের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আবার। আমাদের এখানে করোনার কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কিন্ত ওই যে বলা হচ্ছে, আবার মাস্ক ব্যবহার বা স্যানিটাইজ়ারে হাত ধোয়ার কথা, ভিড়ের থেকে দূরে থাকতে, তাতেই মানুষ কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছেন। এ বার যেন করোনা একটা গুজবের মতো হয়ে যাচ্ছে।’’
তিনি জানাচ্ছেন, নানা অসত্য খবর বাজারে আসছে আর ব্যবসার উপরে তার প্রভাব পড়ছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিষয়টা নিয়ে সরকার নজর দিন। না হলে শুধুমাত্র কাগজে-কলমে করোনার জেরে আবার মুখ থুবড়ে পড়বে সবে ঘুরে দাঁড়ানো বাজার।”
এবারের করোনা সংক্রমণের খবরের জেরে উদ্বেগের চেয়ে অনেক বেশি বিরক্ত ব্যবসায়ী মহল। করোনা নিয়ে আলোচনায় সেই বিরক্তি তাঁরা গোপন করছেন না। নদিয়ার বণিকসভার কথায়, ২০২০ সালে লকডাউনের পর বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দু’বছর পর বিগত কয়েক মাসে সেই বাজার একটু একটু করে চাঙ্গা হচ্ছে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গত তিন মাসে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসার বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশ। ঠিক এই সময়ে ফের করোনা নিয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছে। আর কোথাও কিছু হোক না হোক, বাজারে তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যা আদৌ ভাল চোখে দেখছেন না ব্যবসায়ীরা।
ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেডের যুগ্ম সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা এই প্রসঙ্গে বলেন, “যে মুহূর্তে চিনের করোনা নিয়ে আলোচনা শুরু হল, অমনি শেয়ার বাজার পড়তে শুরু করেছে। ব্যবসার জন্য এটা খুব খারাপ লক্ষণ।”
তাঁর ব্যাখ্যায়, বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এটাই শেয়ার কেনার ঠিক সময়। যা শুনে অনেকেই শেয়ারে টাকা বিনিয়োগ করবেন। ফলে। বাজার থেকে নগদ টাকা এক লপ্তে কমে যাবে। আর নগদ টাকার জোগান কমে যাওয়া ব্যবসায়ী মহলের কাছে সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ। বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে করোনা নিয়ে ভাবনার রাস্তা তৈরি করে অভিমুখ বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলছেন তাঁরা।
ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেডের সভাপতি হরিদাস দে-র কথায়, “ব্যবসা বৃদ্ধির হার বাড়লেও কমেছে লাভের পরিমাণ। কেননা কাঁচামালের দাম, জিএসটি, মজুরি, পরিবহণ ব্যয়-সহ যাবতীয় খরচ কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে। ক্রমাগত লোকসানের জেরে বহু ব্যবসায়ী বাধ্য হয়েছেন তাঁদের পেশা বদলে ফেলতে। তার পর যদি অকারণে করোনার কথা ছড়ানো হয়, তা হলে মানুষ শেষ হয়ে যাবেন।”
ব্যবসায়ীদের কথায়, ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে বাজারের চরিত্র বদলেছে অকল্পনীয় ভাবে। অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে অনলাইন কেনাবেচা। ছোট ছোট ‘স্ট্যান্ড অ্যালোন’ দোকানের বদলে বিশালাকার শপিং মল ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ছে। নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, রানাঘাট, চাকদহ বা কল্যাণীর মতো শহরে স্থানীয় বাজারের দখল নিচ্ছে বৃহৎ পুঁজির ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ওই সব শহরের বাজার প্রধানত সংলগ্ন গ্রামীণ এলাকার ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল।
সেই গ্রামীণ ক্রেতাদের মধ্যে নবীন প্রজন্ম মল বা অনলাইন বিপণনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে, চিরাচরিত ব্যবসা নিয়মিত খরিদ্দার হারাচ্ছে। ফলে, স্থানীয় বাজারে আর্থিক লেনদেনে ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে।
এই অবস্থায় বাজারে নতুন করে করোনার আলোচনা স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীদের। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “ব্যবসায়ীরা এখনই খারাপ কিছু ভাবতে চাইছেন না। নতুন করোনা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে ব্যবসায়ী মহল। তবে মানুষ মাস্কটা যেন ব্যবহার করেন। তা হলে ঝুঁকির সামান্যতম আশঙ্কাও থাকবে না।”