তখনও মধ্যগগনে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র
ভিড় থইথই হলে ঢুকিয়ে লোকটা ফিসফিস করে বলেছিল, “পিছন দিকে ১০ নম্বর রোয়ে একদম কোণের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ুন।”
মঞ্চে তখন গানের প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়াচ্ছে। উপচে পড়া মহাজাতি সদনে গাইছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়! পরের ঘণ্টা দেড়েক কোথা দিয়ে কেটেছিল আজ আর মনে নেই নিত্যানন্দ আচার্যের। শুধু মনে আছে, সে দিন সন্ধ্যা যখন শেষ গান গাইছেন ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’, তার মধ্যে দশ নম্বর রো থেকে এগিয়ে তিনি একেবারে সামনের সারিতে।
গল্পটা আটের দশকের গোড়ার দিকের। ক্লাবের যাত্রার বায়না করতে কলকাতা গিয়েছিলেন নবদ্বীপের নিত্যানন্দ। চিৎপুরে কাজ সেরে হাঁটতে হাটতে সোজা মহাজাতি সদনে পৌঁছে যান গানবাজনা-পাগল বছর তিরিশের যুবক। তাঁর কথায়, “কলকাতায় গেলে তখন মহাজাতি সদন-টদনে ঢুঁ দিতাম। সে দিন গিয়ে দেখি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং সম্ভবত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গাইবেন। টিকিট মিলল না। এক জন বললেন, গান শুরু হওয়ার পর বসিয়ে দেবেন, টাকা তাঁকে দিতে হবে। তাতেই রাজি!”
নিত্যানন্দের বেশ মনে আছে, সেই সন্ধ্যায় একটি অনবদ্য ভজন গেয়েছিলেন সন্ধ্যা। তাতেই সবচেয়ে বেশি হাততালি পড়েছিল। সন্ধ্যা বলেছিলেন, “আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষার্থী। এ সব গান গাইতেই আমার বেশি ভালো লাগে।”
শিল্পীর পেশাদার জীবন থেমেছে অনেক আগেই। কিন্তু মনে-মনে গান গাওয়া কি আর থামে? বন্ধ হয়নি নিজের জন্য গাওয়া এবং সমকালীন গান শোনা। বছর দুয়েক আগের কথা। কৃষ্ণনগর গানমেলায় গাইতে এসেছেন রানাঘাটের অভিষেক বসু। গানমেলার মুখ্য উদ্যোক্তা, গীতিকার সৈকত কুণ্ডু কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন যে অভিষেক সন্ধ্যার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সৈকতের কথায়, “অভিষেকের কাছেই জানতে পারি যে উনি আমার লেখা গানেরও খোঁজ রাখেন। ওকে বলেছিলাম, ওঁর আত্মজীবনী ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’-তে একটা সই এনে দিতে। উনি সই করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আশীর্বাদের মতো থেকে গেল আমার কাছে।”
সন্ধ্যার প্রয়াণের খবর জানার পরে মঙ্গলবার রাতে অবশ্য কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না অভিষেক বসু। ফোনের কলার টিউন ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে… কিছুক্ষণ আরও’ টানা বেজেই চলে।
ফোন ধরে শুধু বলেন, “আমি ওঁর পরিচিত, এই কথা বলার যোগ্যতাও আমার নেই। আমি ওঁকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। তার জবাবে উনি ফোন করেছিলেন। এক দিন পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই পাঁচ মিনিটের দেখা শেষ হয়েছিল দেড় ঘণ্টায়। পরে উনি বলেছিলেন, আমি যেন ওঁকে ‘মা’ বলে ডাকি। আমি মাতৃহারা হলাম।”