ধরাছোঁয়ার বাইরে পদ্মার ইলিশ। —ফাইল চিত্র।
বাঙালির প্রিয় পদ্মার ইলিশ এখন দুর্মূল্য। এক দিকে, ভারতে ইলিশ রফতানির কারণে বাংলাদেশের বাজারে ইলিশের জোগানে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেখানে ইলিশের দাম এক ধাক্কায় প্রচুর বেড়েছে। অন্য দিকে, দুর্গোপুজোর আগে কয়েক টন ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। কিন্তু দাম দেখে পদ্মার ইলিশকে পাশ কাটাচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে ইলিশের মরসুমে কলকাতা-সহ সারা বঙ্গে চাহিদা বাড়ছে কম দামি সামুদ্রিক ইলিশের। ব্যাপক আর্থির ক্ষতির আশঙ্কায় দুই বাংলার আমদানি এবং রফতানির বরাত পাওয়া মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
বেনাপোল আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর দিয়ে পদ্মার ইলিশ পৌঁছোয় রাজ্যে। সেখান থেকে হাওড়া-সহ পাইকারি বাজার হয়ে আমদানি হওয়া ইলিশ পৌঁছে যায় জেলার বাজারগুলিতে। আগামী ১০ অক্টোবর পর্যন্ত এই ইলিশ রফতানি চলবে। দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে মোট ২ হাজার ৮০ মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রফতানির কথা। বাংলাদেশের মোট ৫২ জন রফতানিকারক এই ইলিশ রফতানির বরাত পেয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে ৪০ থেকে ৫০ টন পর্যন্ত ইলিশ রফতানি করতে পারবেন বলে বাংলাদেশ মৎস্য দপ্তর সূত্রে খবর। এর মধ্যে সমস্যা হয়েছে ভিন্ন। ভারতে ইলিশ রফতানির আগে ‘রফতানি হতে পারে’ এই খবরেই বাংলাদেশে রুপোলি শস্যের দাম বাড়ছিল। আর ওই ইলিশ যখন এ রাজ্যের বাজারে এসে পৌঁছোচ্ছে, তা মধ্যবিত্ত ক্রেতার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারে সপ্তাহ জুড়ে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। খুচরো বাজারে ইলিশের সরবরাহ কমে যাওয়া এর অন্যতম কারণ বলে জানাচ্ছেন ঢাকার ইলিশ ব্যবসায়ী শরিফুল আনসারি। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতে প্রতিশ্রুতি মতো ইলিশের সরবরাহ দিতে গিয়ে সরকারি মৎস্য আড়ৎগুলো হিমশিম খাচ্ছে। তাই দেশের বাজারে পদ্মার ইলিশের জোগান কমছে। সেই সুযোগে ঝোপ বুঝে কোপ মারছেন ট্রলার মালিকেরাও। তাই ইলিশের দাম বাড়ছে।’’ ভারতের রফতানি শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ঠিক কতটা বেড়েছে ইলিশের দাম? ঢাকার খুচরো ইলিশ ব্যবসায়ী কামাল হোসেনের দাবি, ‘‘কেজি প্রতি ছোট ইলিশের দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বড় ইলিশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।’’ তা ছাড়া, এখন বাড়তি দাম দিয়েও তাঁদের মতো খুচরো ব্যবসায়ীরা চাহিদা মতো ইলিশ পাচ্ছেন না বলে বলে দাবি কামালের।
বেনাপোলের ইলিশ রফতানিকারক নুরুল আমিন বিশ্বাস জানাচ্ছেন, ভারত-বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি কেজি ইলিশ তাঁরা ১০ ডলারে রফতানি করছেন। ভারতে ইলিশ পাঠাতে গিয়ে দেশীয় বাজারে কিছুটা ঘাটতি যে হবে, তা আগে থেকেই তাঁরা জানেন। কিন্তু নুরুলের দাবি, রফতানির কারণ দেখিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে ইলিশের দাম নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘ইলিশ রফতানিকারকেরা ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ ভাবে ব্যবসা করেন। বাজারে যে দামে শেষ পর্যন্ত বিক্রি হবে, তার উপর তাঁরা লাভ ভাগাভাগি করে নেন।’’ এই যুক্তি আবার মানতে রাজি নন ঢাকার কমলপুর রোডে অবস্থিত ‘ক্যাফে ইলিশ রেস্তোরাঁ’র ম্যানেজার আবুল হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘কালোবাজারির কোনও প্রশ্ন নেই। বাজারে পদ্মার ইলিশই নেই। সবটাই ভারতে রফতানি করা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম বলে আমাদের এখানে তরতরিয়ে ইলিশের দাম বাড়ছে।’’ কতটা প্রভাব পড়ছে দামে? ‘ইলিশ ক্যাফে’-এর কর্ণধার মানিক শেখ বলেন, ‘‘সপ্তাহ দুয়েক আগেও ভাপা ইলিশের প্লেট আড়াইশো থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছি। পদ্মার ভাপা ইলিশের সেই প্লেটই এখন ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’’ ঢাকার কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সুকিয়া খাতুনের খেদ, ‘‘ইলিশের মরসুমের শেষের দিকে আমরা কোথায় একটু বেশি বেশি ইলিশ খাব, তা না, উল্টো দিকে ভারতে পাঠিয়ে আমাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল।’’
বাংলাদেশ থেকে প্রধানত হাওড়া, শিয়ালদহ এবং পাটিয়াপুকুর পাইকারি বাজারে ইলিশ যায়। সেখান থেকে কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন খুচরো বাজারে ইলিশ বিক্রি হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ইলিশ নিয়ে খুশি নয় এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা। এখানে ১ কেজি কিংবা তার বেশি ওজনের বাংলাদেশি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২,০০০ থেকে ২,২০০ টাকায়। স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ ক্রেতারা বাংলাদেশি ইলিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এখন আমদানি করা ইলিশ নিয়ে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ী মহল। এ নিয়ে ‘ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বাজারে যে দামে পদ্মার ইলিশ বিক্রি হচ্ছে, এত খরচ করে এ দেশে এনে সেই দাম পাওয়া যাচ্ছে না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এই বছরের অভিজ্ঞতা পরের বছরগুলোতে ইলিশ আমদানির ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে।’’