এ ভাবেই পাড় ভাঙছে। কল্যাণীর সান্যাল চরে। নিজস্ব চিত্র।
ভাগীরথীর ভাঙনে বাড়িঘর, জমিজিরেত সব গিয়েছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে নদিয়ার কল্যাণী ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের। বাঁচার তাগিদে ভাগীরথীর অন্য পার, হুগলির বলাগড় ব্লকের চরে মাটি কাটার কাজ করতে শুরু করেন তাঁদের একাংশ। ‘বেআইনি’ জেনেও সরে আসতে পারেননি! মাসখানেক ধরে প্রশাসনের তৎপরতায় ওই কাজ বন্ধ হওয়ায় গোটা চরটিই দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন ভুক্তভোগীরা, এমনটাই অভিযোগ।
তাঁদের এ ভাবে মরিয়া হয়ে ওঠা নানা প্রশ্ন তুলেছে। মানুষগুলির কর্মসংস্থান নিয়ে কী ভাবছে প্রশাসন? অবৈধ ভাবে মাটি কাটা, বালি তোলা পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করা যাবে?
কল্যাণীর চাঁদুড়িয়া ২ পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের অনেকে জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁরা ভাঙন দেখছেন। ভাঙনে প্রায় নিঃস্ব হয়ে খেতমজুরি করছেন। অন্যত্র ঘর বেঁধেছেন। পারের মানুষ ডরাচ্ছেন ভাঙনের চোখরাঙানিতে। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলছে এখানকার বিশ্বাসপাড়া, মালোপাড়া, সাহাপাড়া, বাবুপাড়া প্রভৃতি এলাকার মানুষের জীবনচক্র। এক সময় এই পঞ্চায়েতে ১৩টি সংসদ ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন ঠেকেছে ছ’টিতে। চাষের জমি হারিয়ে অনেকেই কাজের জন্য ভিন্ রাজ্যে চলে গিয়েছেন। অনেকে জীবিকা খুঁজে নিয়েছেন ভাগীরথীর চর থেকে অবৈধ ভাবে বালি, মাটি কাটার কাজে। সেই মাটি, বালি বিক্রি করেই সংসার চলছে।
স্থানীয় এক যুবকের কথায়, ‘‘বিকল্প কোনও কর্মসংস্থান নেই। প্রশাসনের কড়াকড়িতে গত এক মাস ওই চরে যাওয়া যাচ্ছে না। তাতে অবস্থা আরও শোচনীয়।’’ স্থানীয়দের একাংশের দাবি, তাঁদের দিকে ভাগীরথীর ভাঙনের ফলেই হুগলিতে চর জেগেছে। তলিয়ে যাওয়া জমির রেকর্ড তাঁদের কাছে রয়েছে। তাই, তাঁদের চর ফিরিয়ে দিতে হবে। দুই পারের প্রশাসনকে বারবার বিষয়টি জানানো হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
কল্যাণীর বিডিও খন্দকার মেহেমুদ বলেন, ‘‘বিষয়টি দু’টি জেলার। পর্যালোচনা চলছে। পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’’
চর খয়রামারিও চাইছে স্থায়ী সমাধান। সেখানকার বাসিন্দা, ৬৭ বছরের নির্মল মণ্ডল বলেন, ‘‘কত দিন এমন চলবে! সরকার আমাদের জমির পাট্টা দিক। না হলে কোনও প্রকল্প করুক, যাতে বহু মানুষ কাজ পান।’’ জিরাট পঞ্চায়েতের প্রধান তপন দাসের বক্তব্য, ‘‘এ পারেও গঙ্গার বিস্তীর্ণ এলাকা ভেঙে ওই পারে চর গজিয়েছে। তা হলে তো সেই চর এ পারের মানুষকে দিয়ে দিতে হয়! আর এই চর খয়রামারির মূল ভূখণ্ডের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে। যেমন খুশি মাটি কাটা, বালি তোলা অনুচিত।’’
পরিবেশকর্মীরাও চান, এই কাজ পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হোক। পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নদীর গতিপথে বাধা দিলে প্রকৃতি বিনষ্ট হয়। মানুষের জীবনেই নানা দুর্গতি আসে। প্রশাসনের উচিত বেআইনি কাজ পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করা। যাঁরা সমস্যায় রয়েছেন, তাঁদের রুজি-রুটির বিষয়টি প্রশাসন দেখুক।’’
ভাঙন রোধে এলাকাবাসী স্থায়ী ভাবে পার বাঁধাইয়ের দাবি করছেন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বয়ে। চাঁদুড়িয়া ২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান প্রসেনজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেছি পার বাঁধাইয়ের জন্য। তবে, এত বড় কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।’’
স্থানীয় বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এলাকাবাসীর দাবি, তিনি চাঁদুড়িয়া ২ এলাকায় ভাগীরথীর পাড় বাঁধাইয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও সে কাজ হয়নি। শান্তনু বলেন, ‘‘কল্যাণী এলাকায় ভাগীরথীর ভাঙন ঠেকাতে শীঘ্রই কাজ শুরু হয়ে যাবে। সাড়ে ৭ কিলোমিটার পথে ভাঙন রুখতে কাজের জন্য ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। দরপত্র ডাকার কাজও হয়ে গিয়েছে।’’ চাঁদুড়িয়া ২ পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের দাবি, যে জায়গায় পার বাঁধানোর কাজ হবে, তাতে পঞ্চায়েত এলাকা নেই। (শেষ)