ফাইল চিত্র।
বছর পঁয়ষট্টির মায়া তরফদার ধুবুলিয়ার কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশ থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে ধুবুলিয়া ক্যাম্পে বসবাস শুরু করেছিলেন। এখনও তাঁরা সেখানেই আছেন। কিন্তু এত দিনেও জমির দলিল পাননি। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনার তোড়জোড় শুরু হওয়া ইস্তক তিনি আতঙ্ক কাঁটা হয়ে রয়েছেন। প্রসঙ্গটা উঠতেই প্রায় কান্না ভেজা গলায় তিনি বলছেন, “জমির দলিলটার কেউ একটু ব্যবস্থা করে দিক। না হলে যে আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে!”
কিন্তু কী করে দেওয়া যাবে দলিল? এই জমির মালিক যে কেন্দ্র। রাজ্যের জমিতে যত উদ্বাস্তু কলোনি রয়েছে, সেগুলির বেশির ভাগের বাসিন্দাদেরই আটক থাকার প্রমাণপত্র বা উদ্বাস্তু শিবিরের পরিচয়পত্রের মতো দরকারি নথি দেখাতে পারলে জমির দলিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত বা কেন্দ্রের জমিতে থাকা কলোনির বাসিন্দারা সেই সুযোগ পাননি।
নদিয়ার অন্যতম বড় উদ্বাস্তুপ্রধান এলাকা ধুবুলিয়া। ও পার বাংলা থেকে আসা বহু মানুষ এত সময়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিনেও বেশির ভাগ উদ্বাস্তু পরিবার ‘ফ্রি হোল্ড টাইটেল ডিড’ বা দলিল পাননি। জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু কলোনিগুলির মধ্যে বেশির ভাগ —৩১টির মত কলোনি আছে কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে। সেই জমি এখনও সেনাবাহিনীর নামে। কলোনিগুলিতে প্রায় সাতাশশো মানুষের বাস। কেন্দ্র ওই জমি রাজ্যকে হস্তান্তর না-করায় সেখানে বসবাসকারীদের জমির দলিল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, একই ভাবে রানাঘাটের পাঁচটি ও কল্যাণীর দু’টি উদ্বাস্তু কলোনি কেন্দ্রের জমিতে হওয়ায় তাদেরও দলিল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নদিয়ায় রাজ্য সরকারের জমিতেও প্রচুর উদ্বাস্তু কলোনি আছে। তার মধ্যে ১১৮টি কলোনির অনুমোদন দিয়ে পাট্টা দেওয়া হয়েছে আগে। বছর দুয়েক আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনিক বৈঠকে এসে বাকি কলোনিগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির অনুমোদনের জন্য রাজ্যের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেই মতো জেলা প্রশাসনের তরফে ৬৯টি কলোনিকে চিহ্নিত করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু রাজ্যের তরফে শুধু তাদের জমিতে থাকা ৩১টি কলোনির অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই কলোনিগুলিতে থাকা পরিবারগুলিকে দলিল দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের জমিতে থাকা ৩৮টি কলোনির ভাগ্য ঝুলে থেকেছে।
তবে গত নভেম্বরে রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কেন্দ্রের হাতে থাকা প্রায় ৯৭৩ একর এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা আনুমানিক ১১৯ একর জমিতে থাকা উদ্বাস্তু কলোনির জমির দলিলও রাজ্য দিয়ে দেবে। তার জন্য কেন্দ্র বা ব্যক্তিমালিক যদি দাবি জানায়, রাজ্যই ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের হাত থেকে ওই সব জমি নিয়ে নেবে।
এর পরেই রাজ্যের উদ্বাস্তু, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর থেকে জেলায় নির্দেশ এসেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা জমিতে বসবাসকারী পরিবারগুলিকেও দলিল দিতে হবে। নদিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি সংস্কার) নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, “রাজ্য থেকে ওই নির্দেশ আসার পরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে। আশা করছি, আমরা দ্রুত সেই কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে পারব।”
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে ধুবুলিয়ায় কেন্দ্রের জমিতে থাকা ৩১টি কলোনিতে সমীক্ষার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। রানাঘাট ও কল্যাণীর কলোনিগুলিতে সমীক্ষার কাজ দ্রুত শুরু হবে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে রাজ্যের দেওয়া দলিলের বৈধতা নিয়ে। প্রশাসনের একাংশের মতে, রাজ্য দলিল দিলেও আইনি সমস্যা থেকে যেতে পারে। কারণ কেন্দ্রের হাতে থাকা জমির দলিল রাজ্য আদৌ দিতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন থাকছেই।
একই প্রশ্ন তুলছে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে আসা ‘সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ’। সংগঠনের জেলা সম্পাদক তথা সিপিএম নেতা অশোক চক্রবর্তীর মতে, “কেন্দ্র যদি রাজ্য সরকারকে জমি হস্তান্তর না করে, সে ক্ষেত্রে ওই সব দলিলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এত দিন কেন্দ্রের সদিচ্ছার অভাবে জমির দলিল পায়নি শয়ে-শয়ে পরিবার। এ বার সেই দলিল হাতে এলেও তা নিয়ে আইনি জটিলতার আশঙ্কা থাকবে।”
অশোকবাবুর কটাক্ষ, “বিজেপি তো এখন উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের নিয়ে কুমিরকান্না কাঁদছে। তারা যদি সত্যিই উদ্বাস্তুদের কথা ভাবত, দলিলের ব্যবস্থা করত। সেটা আটকে রাখত না। এতেই ওদের মুখোশ খুলে যাচ্ছে।” রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার পাল্টা দাবি করেন, “এত দিন কেন্দ্রে যে সব সরকার ছিল তারা এটা নিয়ে কিছুই ভাবেনি। আমরা ওই সব জমিতে বসবাসকারীদের দলিল দেব। তখনই ওঁরা বুঝতে পারবেন, কারা আসলে উদ্বাস্তুদের জন্য ভাবে।”
তবে এ সব আশ্বাসে ভুলতে রাজি নন কেন্দ্রের জমিতে থাকা কলোনির বাসিন্দারা। তাঁরা চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব জমির দলিল দেওয়া হোক। তাঁরা চাইছেন স্বীকৃতি, বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির অদৃশ্য খাঁড়া যখন মাথার উপরে ঝুলছে।
ধুবুলিয়ার বাসিন্দা, সত্তর-ছোঁয়া অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দিনেশদন্দ্র দাস বলছেন, “সেই ছোটবেলায় বাস্তুহারা হয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ এই বয়সে এসেও সেই বাস্তুহারা হয়েই রয়ে গেলাম। আমরা চাই, রাজ্য ও কেন্দ্র আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে আমাদের জমির দলিল দিয়ে দিক। তাতে অন্তত শেষ বয়সে পৌঁছে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।”