চোখের সামনে থেকে সরে সরে যাচ্ছে চেনা স্টেশন, চেনা দৃশ্য। অঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।
চারপাশে বড় মায়া!
পেয়ারা গাছের ছায়া এসে পড়েছে পাশের ডোবায়। অস্থির সেই ছায়ায় ভাসছে জোড়া হাঁস। মেঠোপথ দিয়ে গরুর গাড়ি যাচ্ছে খেতের দিকে। এখন ফাঁকা। একটু পরেই ফিরে আসবে ভেজা পাট নিয়ে। বাঁ দিকের বলদটার গাড়ি টানায় মন নেই। গাড়োয়ান মাঝে মাঝেই তার ল্যাজ মুড়ে দিচ্ছে। আমবাগানের মাচায় বসে এ সবই দেখছিল ইমরান। দৃশ্যগুলো তার চেনা। প্রায়ই দেখে। তবে আর দেখা হবে না। সে তো চলে যাচ্ছে।
কলতলায় বাসন মাজছে ইমরানের স্ত্রী ফতেমা। বাসনের সঙ্গে অদ্ভুত ছন্দে সঙ্গত দিয়ে যাচ্ছে রিনরিনে চুড়ি। বছর দুয়েকের ছেলেটা এখন ঘুমোচ্ছে। আর একটু পরেই উঠে পড়বে। কাঁদবে। ফতেমা গিয়ে তাকে খাওয়াবে। তার পরে সে ইমরানকে খুঁজবে। ইমরান ঘরে ঢুকলেই খিলখিল করে উঠবে।
চারপাশে বড় মায়া!
আরও পড়ুন: বহু কথা রাখা হয়নি সাবেক ছিটমহলে
ইমরান শেখ। বয়স ছাব্বিশ। সাকিন লালগোলা। সামান্য জমি রয়েছে। চাষআবাদ করে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। ইমরান তাই কেরল যাবে। কেরলে পরিশ্রম আছে। ভাল রোজগারও আছে। ইমরান প্রথমে রাজি হয়নি। ফতেমাই তাকে রাজি করিয়েছে। কেরলে গেলে সংসারে শ্রী ফিরবে। ছেলেটা ভাল স্কুলে পড়বে। ফিরে আসবে ফতেমার বন্ধক রাখা গয়না।
ইমরান বলেছিল, ‘‘আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না।’’ ফতেমার মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছিল, ‘‘তা হলে তুমি যাবে না, তাই তো? বেশ, তা হলে যেমন চলছে তেমনই চলুক!’’
ইমরানের অভিমান হয়। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে যাবে। হোক কষ্ট। তবুও যাবে। তার টাকা চাই। অনেক অনেক টাকা। সে সব টাকা ফতেমাকে দিয়ে দিবে। তার পরে সে ডুবে থাকবে ছেলে আমবাগান, ডোবা, খেত নিয়েই।
আরও পড়ুন : ডেভিকে রাখতে বাড়ি কলকাতায়
ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছে রাতেই। সাবান, পেস্ট, ব্রাশ, লুঙ্গি, টর্চ, দু’জোড়া জামা-প্যান্টের সঙ্গে ব্যাগে সে ঢুকিয়ে নিয়েছে ফতেমা ও ছেলের বাঁধানো ছবিটাও।
সারারাত ঘুমোতে পারল না ইমরান। জেগে রইল ফতেমাও। তবে বুঝতে দিল না। লালগোলা স্টেশনে অপেক্ষা করবে ঠিকাদার। তার সঙ্গে থাকবে ইমরানের মতো আরও কয়েক জন। ট্রেনে প্রথমে শিয়ালদহ। সেখান থেকে বাসে হাওড়া। হাওড়া থেকে সটান কেরল।
ভোর থাকতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ইমরান। দরজা পর্যন্ত এল ফতেমা। ছেলে তখনও ঘুমোচ্ছে। এই সময় ইমরান খেতের কাজে বেরিয়ে পড়ত। আজ তার পথ অন্য দিকে। ফতেমার চোখে জল। ইমরানের গলায় নোনতা দলা। সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। পাড়ার নেড়ি কুকুরটা তার পিছু পিছু অনেকটা পথ এল।
চারপাশে বড় মায়া!
ভোরের ট্রেন। ফাঁকা। ইমরান জায়গা পেল জানলার পাশে। অন্যেরা গা এলিয়ে দিল। অনেকটা পথ। দিব্যি ঘুমোনো যাবে। ইমরান তাকিয়ে থাকল জানলার বাইরে। চোখের সামনে থেকে সরে সরে যাচ্ছে চেনা স্টেশন, চেনা দৃশ্য। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
আরও পড়ুন : চায়ের দোকানে কাজ করেও আইএএস! দিনহাটায় জীবনযুদ্ধের গল্প শোনাবেন মহারাষ্ট্রের আনসার
ট্রেন ঢুকল কৃষ্ণনগর। পাক্কা আধ ঘণ্টা দাঁড়াবে। ইমরানকে বড় অস্থির দেখাচ্ছে। সে ঘামছে। ট্রেন ছাড়তে আর পাঁচ মিনিট বাকি। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে আচমকা ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ইমরান।
ঠিকাদার থ। বাকিরা অবাক। কী ব্যাপার? ঠিকাদার তড়িঘড়ি ফোন করে ইমরানকে। ফোন বন্ধ। ট্রেনের বাঁশি বাজল। এখনই ছেড়ে দেবে। ঠিক সেই সময় ছুটতে ছুটতে এল ইমরান। জানলার বাইরে থেকে নিজের টিকিটটা ছিঁড়ে নিয়ে বাকি টিকিটগুলো সে ছুড়ে দিল ঠিকাদারের দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘‘মাফ করবেন ভাই। আমার ছেলে, বৌ, ডোবা, খেত ছেড়ে আমি থাকতে পারব না...’’
ট্রেন ছেড়ে দেয়। প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে হারিয়ে যায় ইমরানও।