—নিজস্ব চিত্র।
হালকা গোঁফের রেখা। গলায় এখনও বয়ঃসন্ধির ভাঙন। সরু লিকলিকে হাত জাপটে ধরে আছে হ্যান্ডেল।
লাইসেন্স? নেই। তবুও অনায়াস তিন চাকার নড়বড়ে শহর জুড়ে সদ্য দাপিয়ে বেড়ানো নব্য-যান টোটো। যার সারথী এক ঝাঁক সদ্য কিশোর।
‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কার্যকর করতে পুলিশের চেষ্টার বিরাম নেই। হেলমেটহীন বাইক চালানো রুখতে শহরের আঁকেবাঁকে মোতায়েন পুলিশের পাশাপাশি বসেছে সিসি ক্যামেরা। ধরা পড়লে কারও জুটেছে শুকনো গোলাপ, কারও বা ছানাবড়া। কোথাও বা গাঁধীগিরির ছলে হেলমেট কেনার নির্দেশও। বাস চালকদের নিয়ম মেনে রাস্তায় নামানোর চেষ্টাও অবিরাম। আরও এক ধাপ এগিয়ে আহিরণ পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ অফিসার নিজের বিয়ের কার্ডেও ছেপেছেন ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর অমোঘ বাণী। কিন্তু বজ্র আঁটুনি গেরো ফস্কাই থেকে গিয়েছে। গাঁ-গঞ্জের কিশোর টোটো চালকদের দৌরাত্মের দিকে চোখটা বুজেই রয়েছে জেলা পুলিশ। এ দাপট সব থেকে বেশি কান্দি মহকুমায়।
মেঠোপথ, পিচরাস্তা ভেঙে সওয়ারি নিয়ে ছুটে চলে টোটো। জলঙ্গি, সাগরপাড়া, শেখপাড়া, ইসলামপুর, রানিনগর-সহ ডোমকল মহকুমা জুড়েই এ ছবি ছিল কমবেশি সকলেরই চেনা। এখন বহরমপুর, হরিহরপাড়া, কান্দি, খড়গ্রাম, বড়ঞা, সালার, ভরতপুর, লালবাগ, জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা, লালগোলা—সর্বত্রই একই চিত্র। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাত্রী নিয়ে টোটো ছুটছে নাবালক কিশোরের দল। শহরের ভেতরের রাস্তায় হোক অথবা জাতীয় কিংবা রাজ্য সড়কের উপরে টোটো নিয়ে ছুটছে কচি হাত। অসুস্থ রোগী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে খুদে পড়ুয়াদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার ভার পড়ে ওই নাবালক হাতে। এ প্রসঙ্গে কান্দি মহকুমাশাসক অভীককুমার দাস বলছেন, “অল্পবয়সী টোটো চালক যে নজরে পড়ে না, এমনটা নয়। দ্রুত পদক্ষেপ করা উচিত। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
রুগ্ন, শুকনো চেহারার সেই সব সদ্য কিশোরেরা আকারে-প্রকারে এখনও ছোট-খাটো। ব্রেক প্যাডে পা রাখতে গিয়ে আসন ছেড়ে একটু উঠে পড়তে হয় তাদের! তা দেখে কোনও কোনও যাত্রী চমকে ওঠেন। রে রে করে ওঠেন কেউ কেউ। কিন্তু সে সবের পরোয়া না করে উড়ে আসে খুদে চালকের আশ্বাস, ‘‘চিন্তা নাই। এক্কেবারে পাকা হাত!’’
এমনিতেই টোটোর বাড়বাড়ন্তে অতিষ্ঠ প্রশাসন। গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো যন্ত্রণা বাড়িয়েছে এই খুদে চালকেরা। যাদের ‘পাকা’ হাতের সৌজন্যে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘কার টোটো কে চালাচ্ছে, সে হিসেব রাখা কি সহজ কথা! আর এই সব পুচকে ছেলেরা রীতিমতো ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। এক রাস্তায় এক জনকে আটকাতে না আটকাতে অন্য রাস্তা দিয়ে আরও পাঁচ জন টোটোবোঝাই যাত্রী নিয়ে ছুটছে। আর এদের অভিভাবকেরাও কোন আক্কেলে যে এদের ছেড়ে দেয়!’’
ওই কিশোর টোটো চালকদের মধ্যে কেউ নবম শ্রেণির, কেউ আবার একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তার অধিকাংশ আবার স্কুল-ছুট। দিনের পর দিন স্কুল কামায় করে কচি হাতে টোটো নিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। দিনের শেষে আয় পাঁচশো থেকে সাতশো টাকা।
বড়ঞা থানার ববরপুর গ্রামের তারক সাহা জানায়, সে নবম শ্রেণির ছাত্র। বাবা চাষের কাজে ব্যস্ত। ছ’জনের সংসার চালাতে বাধ্য হয়েছে সে টোটো চালাতে। পারে না। তাই বাধ্য হয়েই স্কুল কামায় করে টোটো চালাচ্ছি।” এ ভাবে স্কুল কামায় করে টোটো চালালে পড়াশোনার ক্ষতি হয়না? ছোটন বলছে, “ক্ষতি তো হচ্ছে, কিন্তু কী করব! সারাদিনে সাতশো টাকাটাও তো কম নয়? কে দেবে ওই টাকা।” কান্দির বিধায়ক তথা কান্দি পুরসভার পুরপ্রধান অপূর্ব সরকার বলেন, “পুরসভার তরফে ওই চালকদের সচেতন করা হবে।’’