Onion

সোনা-গরু এখন অতীত, সীমান্ত জুড়ে অন্য জিনিস পাচারের রমরমা, ঘুরপথে বস্তা-বস্তা যাচ্ছে বাংলাদেশ!

চাহিদার ভিত্তিতেই তো জোগান বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া সোনা বা গরু পাচারের ঝক্কি অনেক। ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি তো আছেই। আছে বিশাল আর্থিক লোকসানের ঝুঁকি। এই জিনিস পাচারে অবশ্য সেই চাপ নেই।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

করিমপুর শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৫২
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সন্ধ্যা নামলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাচ্ছে আড়তগুলিতে। হুড়মুড়িয়ে চলছে কেনাকাটি। বস্তুটি পেঁয়াজ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক কিলোমিটার পথ পার করতে পারলেই যার মুনাফা এখন কয়েক গুণ। মাঝখানে বাধা বলতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রহরা এবং কয়েক মিটার কাঁটাতার। সেই নজরদারি আর বাধা পেরিয়ে কয়েক বস্তা পেঁয়াজ কাঁটাতারের ও পারে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে। পকেটে ঢুকবে কড়েকড়ে নোট। বস্তা পিছু ২,৪০০ থেকে ২,৫০০ টাকা পাচ্ছেন পেঁয়াজ পাচারকারীরা। বস্তুত, সোনা, গরু এবং মাদকের পর ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচাকারীদের ‘সেরা পছন্দ’ এখন পেঁয়াজ।

Advertisement

ভারত থেকে রফতানি বন্ধের পর বাংলাদেশে পেঁয়াজ এখন অগ্নিমূল্য। কোথাও কোথাও ১৫০ টাকা, তো কোথাও ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পেঁয়াজ পাচারের বাড়বাড়ন্ত। আসলে সোনা বা গরু পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়লে কয়েক লক্ষ টাকার ক্ষতি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই সোনা বাঁচানোর চেষ্টা করেন পাচারকারীরা। গরুকে লুকিয়ে পার করানো বড় ঝক্কির। কিন্তু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সে সব ভয় নেই। বিএসএফের কাছে ধরা পড়লেও পাচারকারীদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম। আর চাহিদার ভিত্তিতেই তো যোগান! তাই পাচারকারীদের প্রথম পছন্দ এখন পেঁয়াজ। তা মুনাফা কেমন হচ্ছে? মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জের বাসিন্দা রফিকুলের (নাম পরিবর্তিত) কথায়, ‘‘বিভিন্ন লাইন সামলে দিন প্রতি সোনা পাচার করলে যে রোজগার হত, প্রায় তার কাছাকাছিই রোজগার হচ্ছে পেঁয়াজ পাচার করে।’’ ওই পাচারকারী জানান, প্রতিটি বস্তায় ৫০ কেজি পেঁয়াজ থাকে। বস্তা প্রতি ১০ হাজার টাকায় পাচার করছেন। আর যদি ধরাও পড়েন, সে ক্ষেত্রে তো সোনা কিংবা মাদকের তুলনায় লোকসানের পরিমাণ নগণ্য। তাই সোনা, গরু, হেরোইন ছেড়ে পেঁয়াজ পাচারই এখন পাচারকারীদের কাছে বেশ লোভনীয়। অন্য দিকে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাচারকারীদের বদলে যাওয়া পছন্দ নিয়ে ‘বিড়ম্বনা’ বাড়ছে বিএসএফ এবং শুল্ক দফতরের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএসএফ জওয়ানের কথায়, ‘‘অন্ধকার আর শীতের ঘন কুয়াশার সুযোগ নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পেঁয়াজ পাচারের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তা ছাড়া ‘জিরো লাইন্স’-এ কৃষিজমি থাকা ভারতীয় নাগরিকেরা ও পারে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মধ্যেই লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পেঁয়াজ।’’ শুধু কি তাই? পেঁয়াজ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় বীজের মধ্যেও পেঁয়াজ পাচার হচ্ছে বলে জানান ওই বিএসএফ জওয়ান।

পেঁয়াজ পাচারে ঝোঁক বৃদ্ধির কারণ জানতে খোঁজখবর করতে করতে নদিয়ার এক ‘পাচারকারী’র কাছে পৌঁছনো গেল। প্রশ্ন শুনে হাসিহাসি মুখে তিনি বলেন, ‘‘বিএসএফ তো এখন নতুন পাচার নিয়ে খুব সতর্ক হয়ে পড়েছে। আমাদের চেষ্টাও চলছে।’’

Advertisement

এই পাচার পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায়? দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টইয়ারের বিএসএফের ডিআইজি কে আর্য বলেন, ‘‘সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনও প্রকার পাচার আটকাতে আমাদের জওয়ানরা অত্যন্ত তৎপর।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বাংলাদেশে যে কোনও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলে সেটারই পাচারের প্রবণতা বেড়ে যায়। এখন সে দেশে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পাচারকারীরাও পেঁয়াজ পাচারের চেষ্টা করছে। তাই আমরা আরও সতর্ক হচ্ছি।’’ বস্তুত, আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারত থেকে আর কোনও পেঁয়াজ পাঠানো হবে না বাংলাদেশে। ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সিদ্ধান্ত। তার পরেও বাংলাদেশের কোনও কোনও খোলা বাজারে পেঁয়াজ ডবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে।

নদিয়ায় করিমপুর পাট্টাবুকা বাজারের পেঁয়াজের পাইকারি আড়তদার রমেশ মণ্ডল বলেন, ‘‘কয়েক দিন ধরে দেখছি, সন্ধ্যা হলেই পেঁয়াজের বিক্রি বেড়ে যাচ্ছে।’’ সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক রমেশের সংযোজন, ‘‘কে, কী কারণে (পেঁয়াজ) কিনে নিয়ে যাচ্ছে, তার তদন্ত করা তো আমাদের কাজ নয়। বিক্রি হচ্ছে ভাল, সেটাই আসল ব্যাপার।’’ ও পার বাংলার পেঁয়াজ-পরিস্থিতি ঠিক কেমন? বাংলাদেশের মেহেরপুরের খুচরো ব্যবসায়ী ইশা মণ্ডল ফোনে বলেন, ‘‘ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করতেই এখানে মজুত করার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। যাঁর যতটুকু প্রয়োজন, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পেঁয়াজ মজুত করছেন। তাই খোলা বাজারে পেঁয়াজ প্রায় নেই বললেই চলে। এখন দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।’’ ঢাকার পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আমিরুল কবিরাজের কথায়, ‘‘ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হতেই চিনা পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে দেশে। কিন্তু স্বাদ আর ঝাঁজের দিক দিয়ে বাংলাদেশিদের প্রথম পছন্দ আপনাদের (ভারতীয়) পেঁয়াজ। সে জন্য দাম বেশি হলেও ক্রেতারা ভারতীয় পেঁয়াজ চাইছেন। এখন সরকারি ভাবে না হলেও ঘুরপথে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতিদিনই বিভিন্ন আড়তে ঢুকছে।’’

সমস্যার কথা বিলক্ষণ জানেন শুল্ক দফতরের আধিকারিক আরপি সিংহ। তাই সক্রিয়তা বাড়িয়েছেন তাঁরাও। তিনি বলেন, ‘‘মুনাফার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে পেঁয়াজ পাচারের খবর আসছে। তাই শুল্ক দফতরের গোয়েন্দাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement