পলিয়েস্টারের লুঙ্গি আর আদুল গায়ে হাতে একটি ছোট্ট পাচন নিয়ে বাগান পায়চারি করেন বাঞ্ছারাম। বাগানের প্রতিটি গাছ তাঁর প্রিয় বন্ধু। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘বাঞ্ছারামের বাগান’। ১৯৮০ সালের তপন সিংহের সেই ছবি নয়। নদিয়ার এক সত্যিকারের বাগান-মালিকের কাহিনি এটি। ঘটনাচক্রে তাঁর নামও বাঞ্ছারাম আর তিনিও ১৯৮০ সাল থেকেই বাগানের মালিক। তাঁর বাগানের লিচু এখন পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। পর্দার বাঞ্ছারামের সঙ্গে বাস্তবের বাঞ্ছারামের মিল অনেক। দুই বৃদ্ধই বাগান বলতে অজ্ঞান।
নদিয়ায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে শান্তিপুর মোড় নেমে টোটো কিংবা অটোতে যেতে হয় গয়েশপুর এলাকা। সেখান থেকে আলুইপাড়া পৌঁছে মিনিট পাঁচেকের মেঠো পথ ধরে হাঁটলেই বাউসডাঙা গ্রাম। সেখানে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে বাঞ্ছারামের বাগানের ঠিকানা।
শান্তিপুর এলাকায় সাত বিঘা জমি জুড়ে প্রচুর আম এবং লিচু গাছ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যে বাগানের লিচুর দারুণ চাহিদা। ওই বাগানের মালিক বাঞ্ছারাম ধাড়া।কিছু দিন আগেই তাঁর বাগানের লিচু গিয়েছে ইংল্যান্ড এবং কানাডায়।
দেড়শো বছর আগেকার কথা। ইংরেজ আমলে এক ইজারাদার এই বাগানটি তৈরি করেন। কালক্রমে সেই বাগানের মালিকানা পান এক জমিদার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাঞ্ছারাম ধাড়ার ঠাকুরদা মোট ৭০ বিঘা বাগানের স্বত্ব কেনেন খাজনার বিনিময়ে। পরে ভূমি সংস্কারের সময় ‘মাঠ খসড়ায়’ এই বিশাল বাগানের মালিক হন বাঞ্ছারামের অন্য এক পূর্বপুরুষ। পৈতৃক সূত্রে এখন সাত বিঘা জমির মালিক বাঞ্ছারাম। বৃদ্ধ জানাচ্ছেন, ১৯৮০ সালে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগির পর ৭ বিঘা বাগানের মালিকানা পেয়েছেন তিনি। সেই থেকে সকলের মুখে মুখে ফেরে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর কথা।
পর্দার বাঞ্ছারামের মতো এই বাঞ্ছারামও বাগান অন্তঃপ্রাণ। সন্তানস্নেহে তিনি বাগানের প্রতিটি গাছকে লালন-পালন করেন। সাদা গোঁফ, বেঁটেখাটো চেহারার বাঞ্ছারামের কথায়, ‘‘জীবনের বেশির ভাগ সময়ই এই বাগানে কাটিয়ে দিয়েছি। সেই থেকে এই বাগানটিকেও সবাই ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ বলে ডাকেন।’’ তবে শুধু নাম নয়, গুণমানেও চর্চিত এই সাত বিঘা জমি। বিশেষত বাঞ্ছারামের বাগানের লিচুর জন্য। এই বাগানের লিচুর আকার, রং এবং স্বাদ কাছেপিঠের বাগানের ফলনকে কয়েক গোল দেবে। জনপ্রিয়তা এমনই যে, বাঞ্ছারামের বাগানের লিচু এখন ‘আন্তর্জাতিক’।
পলিয়েস্টারের লুঙ্গি পরনে আদুল গায়ে হাতে একটি ছোট্ট পাচন নিয়ে সারা দিন বাগান তদারকি করেন বাঞ্ছারাম। প্রতিবেশীরা বলেন, বাগানের প্রতিটি গাছ বাঞ্ছারামের প্রিয় বন্ধুর মতো। গাছের চাহিদা এবং সমস্যা নাকি বুঝতে পারেন বৃদ্ধ। তাই এই বাগানের ফলনও এত। এই মরসুমেও বিশাল ফলন হয়েছে। সব মিলিয়ে এ বার ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা লাভের সম্ভাবনা দেখছেন বাঞ্ছারাম।
বাউসডাঙা গ্রামে ফলের বাগান রয়েছে অনিমেষ মণ্ডলেরও। বাঞ্ছারামের বাগান নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আসলে গাছের কোনও সমস্যা হওয়ার আগেই বাঞ্ছা বুঝে ফেলেন। সেই মতো পরিচর্যা করেন। তাই ওঁর ফলন সবচেয়ে ভাল। ওঁর মতো করে লিচু গাছ কেউ চেনেন না।’’ এ সব বলতেই মুচকি হাসি খেলে যায় বাঞ্ছারামের মুখে। বাগানে বসে মধ্যাহ্নভোজন করতে করতে তিনি বলেন, ‘‘গাছ আর সন্তান, দুটোই তো এক। ওদের যত্ন না নিলে ওরা কেন আমাদের দেখবে? ওদের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা অনেক দিনের। শুধু পয়সার জন্য নয়, ভালবেসেই এই বাগানে পড়ে থাকি।’’