প্রতিবাদ উমরপুরে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
সংসদে নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার পরে আতঙ্ক আরও বেড়েছে সংখ্যালঘু মহল্লাগুলিতে। ফলে আধার কেন্দ্রগুলিতেও কার্ড সংশোধনের ভিড় বাড়ছে। সুতির আসনা বিবি বলছেন, “বিয়ের আগে রেশন কার্ড ছিল বাবার বাড়িতে। সেখান থেকে কার্ড আনা হয়নি। শ্বশুরবাড়িতে সবার কার্ড থাকলেও আমার নেই। তাই আধার কার্ডটা জরুরি। কিন্তু আধার কার্ডে রয়েছে বাবার নাম। বাবা মারা গিয়েছেন বহু আগে। এখন বাবার নাম বদলে স্বামীর নাম না বসালে নাকি দেশ থেকে চলে যেতে হবে! ধুলিয়ানের ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। সেখানে বলেছে, নাম বদল করতে স্বামীর ও আমার একসঙ্গে কাগজের প্রমাণ লাগবে। তাই ভোটার কার্ড নিয়ে রঘুনাথগঞ্জ ডাকঘরে ফর্ম নিয়েছি। আগামী বছর অক্টোবর মাসে নতুন কার্ড পাওয়ার কথা। তার মধ্যে আবার কিছু ঘটে যাবে না তো!’’
আহিরণের মজিবুর রহমানের বয়স প্রায় ৫৮। জন্ম এ দেশেই। নাতি, নাতনি সকলেই আছে। তিনি বলছেন, “আমি ঝাড়খণ্ডে রাজমিস্ত্রির কাজ করি। তাই আধার কার্ড হয়নি। এখন ঝাড়খণ্ডে ভোট বলে চলে এসেছি। কিন্তু আধার কার্ডের তারিখ পেয়েছি ৮ মাস পরে। বাড়ির ভিটেজমিও বাবুদের মৌখিক দান করা। তাই কোনও দলিল নেই। পঞ্চায়েতের সদস্য বলল, আধার কার্ড না করালে দেশ ছাড়তে হতে পারে। সেই ভয়েই ছুটে আসা।”
স্বস্তিতে নেই সাগরদিঘির গোপালপুরের রিন্টু শেখও। তিনি বলছেন, “কার্ডে বাবার নাম রহমান। অন্যত্র আছে শেখ। তাই রহমানকে শেখ না করতে পারলে বাবার জন্য হয়তো আমাকে বিদেশি বানিয়ে দেবে। তাই চরকিপাক খাচ্ছি। আমি জন্মেছি সাগরদিঘিতে নিজের বাড়িতেই। কিন্তু বাড়িতে হওয়ায় জন্মের শংসাপত্র নেই। তাই খুব চিন্তায় আছি।”
মেরুপুরের সাফিয়ারা বিবি একমাস আগেই ডাকঘর থেকেই সংশোধন করে নিয়ে গিয়েছেন নিজের নাম। তিনি বলছেন, “নাম সংশোধনের পরে কার্ড পেয়ে দেখি আমার নাম ঠিক হয়েছে। কিন্তু বদলে গিয়েছে বাবার নাম। এই ভুলের জন্য দেশ ছাড়তে হবে না তো?’’
এনআরসি আতঙ্কের রেশ শুধু আধার কেন্দ্রেই নয়, পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ক্লাব, স্কুলের অফিস সর্বত্রই পৌঁছে গিয়েছে। শুধু মুসলিমরা নন, আতঙ্কে আছেন হিন্দুরাও। নিমতিতার পূর্ণ হালদার বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ১৯৭৪ সালে। তিনি বলছেন, “রেশন কার্ড, আধার কার্ড সবই আছে। জমি কিনেছি ১৯৮০ সালে। তারও দলিল আছে। কিন্তু অসমে ১৪ লক্ষ হিন্দু এনআরসি-র আওতায় ক্যাম্পে। তার পরেও হিন্দু হয়ে ভরসা রাখতে পারছি কই? সবাই ভয় দেখাচ্ছে। আবার বাংলাদেশে পুশব্যাক করবে না তো?”
এনআরসি-র আতঙ্কে নাওয়া খাওয়া ভুলে আধার কার্ডের জন্য তাই এই শীতের রাতেও লাইন দিয়ে পড়ে থাকছেন তাঁরা। ডাকঘরের সামনে, খোলা আকাশের নীচে।