শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণনগর টপকে আমঘাটা। চলতে চলতে তার পরেই থমকে গেল রেলপথ। নিজস্ব চিত্র
জমিজটে বছরের পর বছর আটকে রয়েছে রেলপথ তৈরির কাজ। যত দিন যাচ্ছে, ততই জটিল হচ্ছে অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া। কেননা যাঁরা জমি দিতে আপত্তি করেছিলেন, তারা সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরও বেশি সংগঠিত হয়েছেন। পিছনে সক্রিয় রাজনৈতিক সমীকরণ তো রয়েছেই। ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেরই আশঙ্কা, এর আগে রেল ও প্রশাসনকে যে ভাবে পিছু হটতে হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে যে কেউ আপত্তি জানিয়ে বিকল্প পথের সম্ভাবনাও আটকে দিতে পারে।
এখনও পর্যন্ত তিনটি এলাকায় সরাসরি প্রতিরোধ এসেছে। তাতেই থমকে আছে জমি অধিগ্রহণের কাজ। কিন্তু কী ছিল প্রতিরোধের কারণ?
ফকিরতলা
প্রথমে ঠিক ছিল যে আগের ন্যারোগেজ লাইন ধরেই স্বরূপগঞ্জের নবদ্বীপ ঘাট স্টেশন পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে বাঁ দিকে এগিয়ে রেলসেতুর উপর দিয়ে ভাগীরথী পার হয়ে গৎখালি ও তেঘরি মৌজা হয়ে নবদ্বীপ ধাম স্টেশনে গিয়ে মিলবে লাইন। কৃষ্ণনগর থেকে স্বরূপগঞ্জে যেতে মাঝখানে পড়ে ফকিরতলা। আর সেই ফকিরতলাতেই প্রথম বার থমকে যায় এই রেল প্রকল্পের কাজ। প্রস্তাবিত রেললাইনের পাশেই সেখানে আছে একটি দরগা ও একটি মঠ। ব্রডগেজ লাইন তৈরি করতে গেলে ভাঙা পড়ত দুটোরই কিছুটা করে অংশ।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রথম থেকেই ওই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় বাসিন্দারা আপত্তি করতে থাকেন। মিছিল হয়, অবরোধ করা হয় রাস্তাও। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও রেল কর্তৃপক্ষ দফায়-দফায় তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও কোনও সুরাহা হয়নি। প্রশাসনের তরফে দরগাটি পাশের জমিতে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি। প্রথম দিকে মঠ কর্তৃপক্ষও একই রকম অনড় ছিলেন, কিন্তু পরে তাঁরা মঠের কিছুটা জমি রেললাইনের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি হন।
স্থানীয় স্তরে আলোচনা ছাড়াও ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কোনও শর্তেই দরগা কর্তৃপক্ষ রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে স্বরূপগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ তৈরি না করে তেওরখালি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ চাইছেন যে ফকিরতলার উপর দিয়ে স্বরূপগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হোক। কিন্তু সেই সম্ভাবনা ক্রমশ কমে আসছে বলেই মনে করছেন রেলের কর্তাদের একাংশ।
দরগা সরানো নিয়ে এত বাধা কেন? স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের মতেই, এই দরগাটি হিন্দু ও মুসলিম দুই ধর্মেরই আবেগের জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দা বাবলু মণ্ডল বলেন, “আমরা সবাই চাই রেললাইন হোক, কিন্তু দরগা না ভেঙে। প্রয়োজনে দরগার উপর দিয়ে ছোট সেতু করে রেললাইন নিয়ে যাওয়া যেতেই পারে।”
তেওরখালি
ফকিরতলায় প্রকল্প থমকে যাওয়ার পরে বিকল্প হিসাবে ঠিক করা হয়েছিল যে তেওরখালিতে জমি অধিগ্রহণ করে রেললাইন পাতা হবে। রেলের পক্ষ থেকে মানচিত্রও করে ফেলা হয়। সেই মত জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়। হয় সমীক্ষাও। কিন্তু এখানেও বেঁকে বসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের বড় অংশের দাবি, তেওরখালিতে রেললাইন হলে করাতিপাড়া, সর্দারপাড়া, ভকতপাড়া ও বিশ্বাসপাড়ার প্রায় ১৭০টির মতো বাড়ি ভাঙা পড়বে। কিন্তু কোনও ভাবেই বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে তাঁরা রাজি নন। তাই জমির দরদামটুকুও করতে রাজি হননি তাঁরা। শুরুতেই বলে দেন, যতই দাম দেওয়া হোক, জমি তাঁরা দেবেন না।
এক কালে এখানে ছিল ন্যারোগেজ লাইন। এলাকাবাসীর একাংশের বক্তব্য, সেই রেলের জমি থাকতে তাঁরা নিজেদের জমি দেবেন না। রেল পারলে সেই জমির উপর দিয়ে ব্রডগেজ লাইন তৈরি করুক। এর পরে আর কথা এগোয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা জুলহক শেখ বলেন, “বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছেড়ে কোনও ভাবেই কোথাও যাব না।”
মহিশুরা
মহিশুরা গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে দিয়েছে প্রধান রাস্তা। রাস্তার এক পাশে ভাগীরথীর দিকে গৎখালি মৌজা, উল্টো দিকে তেঘরি মৌজা। তেওরখালিতে বাধা পাওয়ার পরে ঠিক হয়েছিল, গৎখালি মৌজা দিয়েই কাজ শুরু করা হবে। সেই মতো জেলা প্রশাসনের কর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা রেলসেতুর মুখ থেকে সমীক্ষা শুরু করেন। কিন্তু মহিশুরা গ্রামে ঢুকেই তাঁরা আবার প্রতিরোধের মুখে পড়েন। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির মূল কারণ, সরাসরি গ্রামের মাঝখানে বাজার এলাকা দিয়ে লাইন নিয়ে যেতে চাইছেন রেল কর্তৃপক্ষ। তাতে গোটা গ্রাম তছনছ হয়ে যাবে। ১২০টির মতো ঘর ভাঙা পড়বে। তার মধ্যে ৩০টির মতো দোকান রয়েছে, যার উপরে অন্তত সমসংখ্যক পরিবার নির্ভরশীল। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পাওয়ারলুমও।
ফলে এই এলাকার বাসিন্দাদেরও সোজা কথা, জমির দাম যত বেশিই দেওয়া হোক না কেন, বাড়ি-দোকান ভেঙে ভিটে-জীবিকাহারা রেললাইন করতে দেওয়া যাবে না। প্রশাসনের লোকজন বাধা পাওয়ার কিছু দিন পরে রেল ও জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে বৈঠক করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ ওরফে নন্দ সাহা। গ্রামবাসীরা তাঁদের মুখের উপরে জানিয়ে দেন, কোনও মূল্যেই তাঁরা জমি ছাড়বেন না। এঁদেরই অন্যতম রাজু শেখ, ইমরান শেখরা বলছেন, “রেললাইন পাতার জন্য গ্রামের মধ্যেকার বাজারের জমি নেওয়া হবে কেন? বাজারের দু’দিকে আধ কিলোমিটার মতো গেলে গ্রামের বাইরেই ফাঁকা জমি আছে। সেই জমির উপর দিয়ে রেললাইন পাতা হোক। আমরাই জমি দেব। কিন্তু ভিটের জমি, দোকানের জমি
দেব না।”
বস্তুত তিন জায়গাতেই স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, একটু সরে ফাঁকা জায়গার উপর দিয়ে রেললাইন নিয়ে গেলেই আর কোনও সমস্যা থাকে না। তা হলে রেলই তা মানছে না কেন? রেল সূত্রের দাবি, লাইনে বেশি বাঁখ থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থাকবে। বিশেষ করে এক্সপ্রেস ট্রেনের যে গতি থাকে তাতে এত অল্প জায়গায় বাঁক নেওয়া যায় না। অনেক প্রযুক্তিগত শর্ত মাথায় রেখে রেললাইন তৈরি করতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মর্জি অনুযায়ী জায়গা বদল করা যায় না।
তবে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক নিখিল চক্রবর্তী বুধবার বলেন, “বিষয়টি আমার সে ভাবে জানা নেই। বিস্তারিত না জেনে কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”