Diego Maradona

ডিয়েগো স্বপ্নেই গ্রাম থেকে পাড়ি মহানগরে

১৯৮২ সালে বেঙ্গালুরুতে ভারতীয় জুনিয়র দলের শিবিরে বসে প্রথম মারাদোনা-জাদুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন নির্মল ভৌমিক।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২০ ০১:৫২
Share:

—ফাইল চিত্র

রাত ঘন হলেই নদীর তীরে নীল আলো ছেলেটাকে নিশির মতো ডাকত। ঠিক আলো নয়… ইশ্বরের পা থেকে ঠিকরে আসা দ্যুতি!

Advertisement

অমনি বাবার বেদম মার ভুলে অন্ধকার গঙ্গার পাড় ধরে পাঁই পাঁই ছুট। হাফাঁতে হাফাঁতে ক্লাবঘরের সামনে। ঢাউস সাদা-কালো টিভি বাক্সের শাটার তখনও খোলাই হয়নি। টিভির একদম সামনে বসতেই হবে। তবেই না ছোঁয়া যাবে রাজপুত্রকে! এ গল্প ১৯৮৬ সালের হলেও ইশ্বর ভজনার শুরু আরও আগে।

১৯৮২ সালে বেঙ্গালুরুতে ভারতীয় জুনিয়র দলের শিবিরে বসে প্রথম মারাদোনা-জাদুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন নির্মল ভৌমিক। গ্রামের কিশোর অবাক হয়ে দেখেছিল, কেমন করে লালকার্ড দেখিয়ে মাঠছাড়া করা হয়েছিল মারাদোনাকে। আর্জেন্টিনার হাত ফস্কে গিয়েছিল বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ। সেই লালকার্ড প্রসঙ্গে উঠতেই তেতো গলায় মধ্য-পঞ্চাশের মারাদোনাভক্ত বলেন, “কোনও ভাবে আটকাতে না পেরে ক্রমাগত মেরে মেরে শেষ করে দিচ্ছিল বিপক্ষের ডিফেন্ডার। মারাদোনা ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা দিতেই লালকার্ড!” বলে চুপ করে যান নির্মল। উত্তেজনা সামলে আবার বলেন, “সারা জীবন এমনই নানা অন্যায় হয়েছে ডিয়েগোর সঙ্গে। কিন্তু সে কখনও মাথা নোয়ায়নি।”

Advertisement

১৯৮৬ সাল। নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্বপাড়ের বাসিন্দা নির্মল তত দিনে জুনিয়র, সাব-জুনিয়ারে জেলা, রাজ্য এমনকি ভারতীয় দলের শিবিরও ঘুরে এসেছেন। সবে কলকাতার সোনালী শিবিরে খেলা শুরু করেছেন। শুরু হল মেক্সিকো বিশ্বকাপ। দুনিয়ার ফুটবল আকাশ তত দিনে মারাদোনা সূর্যের তেজে ঝলসে যাচ্ছে।

“আমাদের গ্রাম চর স্বরূপগঞ্জে দু’এক জন বড়লোকের বাড়িতে টিভি এসেছে। সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। স্থানীয় ক্লাব জনকল্যাণ সমিতিতে এল সাদা-কালো টিভি, বিশ্বকাপের জন্যই। অবাক হয়ে দেখছি দশ নম্বর জার্সির দৌড়, ড্রিবলিং, পাসিং, ফেনটিং। প্রতি দিন রাতে খাওয়া সেরে সবার আগে টিভির সামনে বসে পড়তাম। কারও ক্ষমতা ছিল না আমার আগে টিভির সামনে বসার। পর দিন মাঠে গিয়ে চেষ্টা করতাম। আপ্রাণ চেষ্টা!”

এর পর থেকে যতদিন ফুটবল খেলেছেন, তত দিন নির্মলের জার্সির নম্বর ছিল দশ। পূর্বরেলে খেলার জন্য চাকরি। এখন নবদ্বীপ মিউনিসিপ্যাল স্পোর্টস অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষক এবং আরও একাধিক কোচিং ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত ফুটবলার। নির্মল বলেন, “যখন দশ নম্বর জার্সি পড়ে মাঠে নামতাম, মনে হত, আমিও ওই রকম তীব্রগতিতে ফালাফালা করে দেব বিপক্ষের ডিফেন্স!” মারাদোনার মৃত্যুসংবাদ শুনে তাঁর মনে হচ্ছে, “ফুটবল তার সব রং হারিয়ে ফেলল।”

ওভার টু শিয়ালদহ। আবার সেই ছিয়াশি বিশ্বকাপ।

ঘিঞ্জি কাইজ়ার স্ট্রিটের মেসে কেনা হয়েছে সাদা কালো টিভি। নদিয়া জেলা দলের জুনিয়র টিমের স্ট্রাইকার অমিতাভ বিশ্বাস সবে কলকাতা ময়দান চিনছে। নানা ক্লাবে খেলা ফুটবলারদের মেসে তাঁদের পাশে বসে এক কিশোর অবাক হয়ে দেখে, সবুজ মাঠে বাঁ পা দিয়ে কেমন দুরন্ত গতিতে বুনে চলেছেন আশ্চর্য নকশা। সেই থেকে তার প্রিয় রং আকাশি নীল। ঝাঁকড়া চুলওয়ালা পেশিবহুল একটি অবয়ব সেই থেকে তার রাতের স্বপ্নের সবটুকু দখল করে নিল।

“মাঝমাঠ থেকে একের পর এক অত জনকে কাটিয়ে গোল! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার সেই খেলার উত্তেজনা এখনও চোখ বুজলে অনুভব করি” — আবেগতাড়িত হয়ে বলে চলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ফুটবলার অমিতাভ। সোনালী শিবির, এরিয়ান, রেল ছেড়ে ইস্টবেঙ্গল। ফের রেলে। পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোচিংয়ে দীর্ঘদিন খেলা। আদতে তেহট্টের মানুষ হলেও ফুটবলের জন্য কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতাই এখন তাঁর সাকিন। পূর্ব রেলের কর্মী এবং ইস্টার্ন রেল স্পোর্টস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ এখনও রাজপুত্রের সঙ্গে আলাপের ঘোর কিছুতেই কাটাতে পারেন না।

অমিতাভ বলেন, “আমরা শুধু চেয়ে-চেয়ে দেখতাম এক শিল্পীর নৈপুণ্য। মানুষ চিরকাল ফুটবলের ঈশ্বর মারাদোনাকে মনে রাখবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement