প্রতীকী চিত্র
মাস আটেক আগে ঘরে ফিরে জামাই আদরটা খারাপ পাননি ডোমকল থানার রায়পুর এলাকার ইসমাইল মোল্লা। শাশুড়ি বাড়িতে ডেকে দেশি মুরগির সঙ্গে শেষ পাতে পায়েস মিষ্টিরও ব্যবস্থা করেছিলেন। তেমনই মায়ের হাতের পোলাওটাও মিলে ছিল ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরে। অথচ এ বার ঘরে ফিরে ভাল খাবার দূরের কথা, দু’বেলা ভাতের পাতে আর কী থাকবে, তা নিয়েই কপালে ভাঁজ পড়েছে ইসমাইলের। পাড়ার মুদির দোকানে চাল ডাল আলু ছাড়া ভাল মসলা কিছু মিলছে না। মোড়ের মিষ্টির দোকান পুরোপুরি বন্ধ। লকডাউনের চাপে পড়ে গিন্নির হাতের আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে পেট পুজো হচ্ছে দু’বেলা।
কেবল ইসমাইল নন, লকডাউনের ঠিক আগে ভিন্ রাজ্য থেকে এই জেলায় ফিরেছেন হাজার হাজার শ্রমিক। ডোমকলের গ্রামগুলোতে ঘরে ঘরে এখন লোক ভর্তি। ঘরের যে ছেলেরা ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যান, তাঁরা ভোট ছাড়া কখনও এমন এক সঙ্গে ফেরেন না। কেউ এই পরবে এলেনম, তো কেউ ওই পরবে। এখন সমস্ত গ্রামের বাড়ি সব ভর্তি। কিন্তু লকডাউনের জন্য খাবারও কিছু কম মিলছে। মুদির দোকান, কোথাও মিষ্টির দোকান খোলা। কিন্তু তাতে জিনিসপত্র কম। রেশন ব্যবস্থাই বড় ভরসা। তা সবে শুরু হয়েছে।
জলঙ্গির আনিসুদ্দিন মন্ডল বলছেন, ‘‘একটু যে ভাল মন্দ খাবার খাব, তার উপায় নেই, পাড়ার মুদির দোকানে গিয়ে সে সব খাবারের মসলা চাইলেই সটান বলছে নেই।’’
মুদির দোকানের মালিক পিন্টু মণ্ডল বলছেন, ‘‘সবাইকেই সকাল থেকে খালি বলতে হচ্ছে, নেই নেই। তা ছাড়া, উপায় কী! মহাজনের ঘরে গেলে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া বলছে। ফলে আর সাহস করে সে সব তুলতে পারছি না। চাল ডাল তেল নুন দিয়ে ব্যবসা চলছে।’’ আরও এক মুদির দোকানের মালিক রেজাউল আনসারি বলছেন, ‘‘যা আনছি কয়েক ঘণ্টায় শেষ। মুদির দোকানের মালপত্র আনতে গেলে পুলিশ হয়তো রাস্তায় ছাড় দিতে পারে। কিন্তু ভ্যানে করে যে নিয়ে আসব, তা কে আনবেন? এই অবস্থায় কোনও ভ্যানচালককে বলতেও পারছি না। বললেও তাঁরা অনেক টাকা চাইছেন।’’
শুধু খাবার জিনিসই না। অনেকে তাড়াহুড়ো করে ফিরে এসেছেন। অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই সঙ্গে আনতে পারেননি। আতিকুর রহমান বলেন, ‘‘মাজনটা আনিনি। তা না হয় বাড়িতে পাচ্ছি। কিন্তু টুথব্রাশ পাব কোথায়? দোকানে নেই। টুকটাক আরও কিছু দরকার, সে সব দোকান তো খুলছেই না।’’
তাই ডোমকলের গ্রামের ছবি একেবারেই বদলে গিয়েছে। ঘরে ঘরে ছেলেরা, কিন্তু সেই পরিচিত আড্ডাটাও আর যেন নেই। নেই সেই মোটরবাইক দাপিয়ে ঘোরাফেরা। নেই ঘর ঘর থেকে ভাল রান্নার গন্ধ।
ডোমকলের বিডিও পার্থ মণ্ডল বলেন, ‘‘এমনটা হওয়ার কথা নয়। এমন ব্যবসায়ীদের গাড়ির যাতায়াতে ছাড় রয়েছে। নিয়মিত চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছি। এমন কিছু হলে তা কেন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখছি।’’ তবে প্রশাসনের একটি সূত্রই জানায়, লকডাউনে জিনিসপত্রের অল্পস্বল্প আকাল প্রায় সব গ্রামেই রয়েছে। গ্রামের মুদির দোকানে জিনিস মিলছে না। গ্রামের মানুষ কিন্তু জানাচ্ছেন, ঘরের ছেলেরা যে ঘরে ফিরে এসেছেন, তাতেই তাঁরা খুশি। ভালমন্দ খাবার যে তাঁদের মুখে তুলে দেওয়া যাচ্ছে না, সেই খেদের সময়ও এটা নয়। করোনাভাইরাস রুখতে প্রয়োজন লকডাউনই। তার জন্য যতটা ক্ষতি স্বীকার করতে হয়, তা করতে তাঁরা রাজি।
কিন্তু অন্য সমস্যাও রয়েছে। ডোমকলের কুপিলা গ্রামের যুবক ফিরোজ মণ্ডল বলছেন, ‘‘দিন তিনেকের ধকল কাটিয়ে ঘরে পৌঁছে সব ভুলে যাই। অথচ এ বার ঘরে পৌঁছে খুব খারাপ লেগেছে, একে গ্রামের মানুষ অন্য চোখে দেখেছে আমাদের। প্রায় ১৪ দিন ঘরবন্দি হয়ে থেকে তার পরেও যে একটু আনন্দ উপভোগ করব, সেটা হচ্ছে না। তবে মেনে নিচ্ছি। কেননা, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততেই হবে।’’