প্রতীকী ছবি।
অতীতে কখনও এমন ঘটনার সাক্ষী হয়নি সম্মতিনগর।
রবিবার সন্ধ্যায় বাজারের প্রাণকেন্দ্রে কয়েকশো মানুষের সামনে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আব্দুল করিম শেখ (১৩) নামে এক কিশোর। কিন্তু সেই কিশোরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে এগিয়ে এলেন না কেউ। এমনকি অভিযোগ, দাঁড়িয়ে থাকা টোটো চালকেরাও মুখ ফিরিয়ে রইলেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।দলের বৈঠক সেরে বাড়ি ফেরার পথে মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বড়শিমুলের এক যুবক মইদুর রহমান। নিজের চোখে ঘটতে দেখা দুর্ঘটনায় আহত কিশোরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে এগিয়ে এলেন তিনিই। হাতিবান্ধা গ্রামের এক প্রবীণ টোটোচালকে টোটোয় চাপিয়ে রক্তাক্ত কিশোরকে কোলে নিয়ে রওনা দিলেন মইদুর হাসপাতালের পথে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। পথেই মৃত্যু হল আব্দুল করিম শেখের।
হাসপাতালে পৌঁছলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দুর্ঘটনার কিছু দূরে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন কিছু মানুষ। দুর্ঘটনা স্থলের আশপাশে সম্মতিনগর বাজারে সাড়ে ৫টার সন্ধ্যায় ছিল কয়েকশো মানুষের ভিড়।
তবু দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে এগিয়ে এসেও গা করলেন না কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার।পাশেই সিপিএমের এরিয়া কমিটির অফিস। সেখানেই সবে বৈঠক শেষ করে তার বাইক নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছেন মইদুর রহমান। তিনি এসএফ আইয়ের রাজ্য কমিটির সদস্য।
মইদুর বলছেন, ‘‘অনেকের চোখের সামনে দুর্ঘটনাটি হয়। ও
????????ই কিশোর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে জঙ্গিপুরের দিকে। পিছন থেকে যাচ্ছিল একটি ট্রাক। নিমেষের মধ্যে ট্রাকটি পিষে দিল সাইকেল সহ কিশোরকে। রে রে করে ছুটে এল কয়েকশো মানুষ। দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটি টোটোও। রাস্তায় পড়ে কিশোরের রক্তাক্ত দেহ। বার বার বলছি হাসপাতালে নিয়ে চলুন। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না সাহায্যের জন্য। এ ওর মুখ চাওয়া চায়ি করে দাঁড়িয়ে রইল জনতা। টোটোগুলো যেতে চাইল না।” একটু দূরেই বিশ্বকাপের খেলা দেখার আয়োজনে ব্যস্ত ছিল কিছু ছেলে। এগিয়ে আসেনি তাঁরাও।
মইদুর বলছেন, “তখন ঠিক করি ওই কিশোরকে মোটরবাইকেই নিয়ে যাব ৫ কিলোমিটার দূরে জঙ্গিপুর হাসপাতালে। এক রকম জোর করেই এক জনের গলা থেকে টেনে নিলাম গামছা। কিশোরের মাথার ক্ষতস্থান গামছা দিয়ে চেপে ধরে কোলে নিতেই দেখি এক প্রবীণ টোটোচালক ফিরছেন শহর থেকে। তিনিই টোটো নিয়ে এগিয়ে এলেন। দু’কিলোমিটার পথ যেতেই সেই টোটোর মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল কিশোর আমার কোলেই। তারপর হাসপাতালে পৌঁছতেই চিকিৎসক ঘোষণা করলেন মারা গিয়েছে আগেই।”
মিনিট কুড়ির মধ্যেই খবর পেয়েই হাসপাতালে এলেন কিশোরের বাড়ির লোকজন। বাবা মুকুল শেখ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিন ছেলে মেয়ের বড় আব্দুল করিমই। বাবার আক্ষেপ “একটু তাড়াতাড়ি যদি হাসপাতালে নিয়ে আসা যেত ছেলেটাকে?” মইদুর বলছেন, ‘‘আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক। ফুটবল আমার ভালবাসার খেলা। কিন্তু পারিনি এ দিন আর খেলা দেখতে। বার বার আমার কোলে শায়িত মৃত কিশোরের মুখটা ভেসে উঠেছে। ভাবছি দুর্ঘটনার পর দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন ও টোটোচালকেরা কেউ এগিয়ে এলে দু’চার মিনিট সময়টা হয়তো নষ্ট হত না। হয়তো চিকিৎসার সময়টা অন্তত পাওয়া যেত।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাড়ি রাজ্যের প্রতিমন্ত্রী আখরুজ্জামানের। তিনি বলছেন, “সম্মতিনগর অত্যন্ত জনবহুল এলাকা। দুর্ঘটনা প্রবণও। রাস্তায় পড়ে থাকা কিশোরকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে এই গড়িমসি কেন আমি বুঝতে পারছি না। এমন অমানবিক আচরণ কখনও দেখিনি। আমি একটি অনুষ্ঠানে ছিলাম। খবর পেয়েই রাতেই হাসপাতালে গিয়েছি। অত্যন্ত পরিচিত পরিবার আমার।”
স্থানীয় একটি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও তৃণমূলের মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের জেলা সভাপতি মহম্মদ ফুরকান বলছেন, “২৮ বছর শিক্ষকতা করেছি ওই এলাকায়। দুর্ঘটনায় রাস্তায় পড়ে থাকা আহতকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি এলাকার মানুষ এমনটা কখনও দেখিনি। এটা যদি ঘটে থাকে তবে বুঝতে হবে মানবিকতার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।”