—প্রতীকী চিত্র
চাকদহের বিষ্ণুপুরে সংগঠনের কর্মসূচিতে গান করে ফিরছেন গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা। রাত হয়ে গিয়েছে। আচমকা তাদের গাড়ি আটকে জানালা দিয়ে ভিতরে পিস্তল তাক করল এক যুবক। সঙ্গে কয়েকজন। হুমকি এল, আর যেন দ্বিতীয় দিন এই এলাকায় দেখা না যায়।
সেটা ২০১৬ সাল। তার পরেও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্যেরা নানা জায়াগায় অনুষ্ঠান করেছেন। কোথাও নাটক, কোথাও গান। কিন্তু এই অশান্ত সময়ে, বামপন্থীরা যখন সর্বশক্তি দিয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরোধিতা করছেন, সে ভাবে বামপন্থী শিল্পীদের কি সত্যিই রাস্তায় নামতে দেখা যাচ্ছে? যেখানে সাধারণ মানুষ সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার জন্য, সাম্প্রদায়িক সৌভ্রাতৃত্বের দায়ে রাস্তায় নামছেন, নানা প্রান্তে আন্দোলনে শামিল হতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন? যেখানে ওই আইন বা পঞ্জির বিরোধিতা করায় কল্যাণীতে নাট্যোৎসবের উপরে হামলা চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা, বামপন্থী শিল্পীদের তার প্রতিবাদে সরব হতে দেখা যাচ্ছে কই?
বাস্তব হল, বামপন্থীদের মতো গোছানো শিল্পী সংগঠন কংগ্রেস বা তৃণমূলের নেই। কোনও দিন ছিলও না। ইতিহাস জানে, সেই স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই দেশের অস্থির সময়ে তাঁরা বারবার পথে নেমেছেন। সলিল চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস— কত কত কত নাম। ‘পথে এ বার নামো সাথী’ থেকে ‘ও আলোর পথযাত্রী’র মতো গান তো তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েই সংগ্রামী জনতার হৃদ্মাঝারে গিয়ে বসেছিল এক দিন। যদিও এঁদের অনেককেই পরে গণনাট্য সঙ্ঘ ছেড়ে যেতে হয়েছিল।
নদিয়াতেও গণনাট্যের সুদিন ছিল এক সময়ে। ষাটের দশকের মাঝে অস্থির সময়ে উঠে এসেছিলেন দিলীপ সেনগুপ্ত, দিলীপ বাগচী, সাধন চট্টোপাধ্যায়, নৃসিংহানন্দ ওরফে কালু দত্ত, দেবু গুপ্ত, পূর্ণিমা চট্টোপাধ্যায়রা। গানে-নাটকে-কবিতায় তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরীরা কোথায়? সিপিএমের লোকজনই বলছেন, তেমন কোনও নড়াচড়া চোখে পড়ে না। অথচ এখনও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, আছে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ। এখনও তাদের একাধিক শাখা জেলার নানা প্রান্তে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কোথাও কোথাও হয়তো কিছুটা সক্রিয়ও। কিন্তু মানুষের প্রতিবাদের ভাষা কি তাঁরা আর আগের মতো করে জোগাতে পারছেন?
দুই সংগঠনের নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করছেন, তাঁরা পারছেন। সে কারণে মানুষের সাড়াও পাচ্ছেন। কী রকম? তাঁদের দাবি, ২০১০ সালে জেলায় গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন ১৯৩ জন। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০১। বর্তমানে জেলায় তাদের ১৪টি শাখা রয়েছে। তার মধ্যে কৃষ্ণনগর, চাকদহ, তাহেরপুর, পলাশিপাড়া, আড়ংঘাটা ও সগুনা শাখা ভালই সক্রিয়। শুধু তা-ই নয়। বেথুয়াডহরি, ফুলিয়া তেহট্ট, গাংনাপুর এলাকায় নতুন ইউনিটও খোলা হচ্ছে। তাদের ‘গোপালের মা’ ও ‘সে আমার ছোট বোন’ নাটক দু’টি যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে বলে জেলা নেতাদের দাবি।
গণনাট্য সঙ্ঘের জেলা সম্পাদক দিলীপ বিশ্বাস বলছেন, “এখন নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কিন্তু অনেক বেশি সক্রিয়। মূলত তাঁদের উৎসাহেই আমাদের আরও চারটে ইউনিট খুলতে হচ্ছে।” ইউনিট তো খুলছেন, কিন্তু সেই সক্রিয়তা কোথায়? দিলীপের দাবি, “আমরা আজও একই রকম সক্রিয়। এই তো সে দিন কল্যাণী থেকে গান গাইতে গাইতে লং মার্চে হাঁটলাম। আমরা আছি, আপনারাই শুধু দেখতে পাচ্ছেন না।”
গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের নেতারাও তুলে দিচ্ছেন পরিসংখ্যান। তাঁদের দাবি, এখন জেলায় তাঁদের ২৮টি ইউনিট আছে। ২০১০ সালে যেখানে তাঁদের ১৩৪০ জন সদস্য ছিল, এখন বেড়ে হয়েছে ১৭৪৫ জন। ইউনিটগুলি পত্রিকা বার করার পাশাপাশি নিয়মিত কবি সম্মেলন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। কিন্তু এ সব তো শুকনো সংখ্যা। সক্রিয়তা কোথায়? লেখক শিল্পী সঙ্ঘের জেলা সম্পাদক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় উল্টে বলেন, “বলছেন কী? আমরা নানা আঙ্গিকে সব সময়েই সক্রিয়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে আরও বেশি গতি এসেছে।”
গতি যদি এসেই থাকে, তা নিশ্চয়ই লক্ষ্যভেদও করবে? ফুল ফুটলে তার গন্ধে ভ্রমর আপনিই জোটে এবং তা-ই ফুল ফোটার অকাট্য প্রমাণ, এ কথাটা বামপন্থীরা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?