প্রতিবাদ হয়তো এখনও তেমন জোরালো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আওয়াজটা উঠতে শুরু করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বেআইনি ভাটার বিরুদ্ধে। এলাকার মাটি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে।
কারা সেই আওয়াজ তুলছেন? স্কুলের পড়ুয়া, গ্রামের মহিলা, চিকিৎসক, আটপৌরে ব্যবসায়ী, কখনও আবার ছাপোষা কোনও প্রৌঢ়। তাঁরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘ভয় পেয়ে পিছু হঠতে হঠতে এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। প্রশাসন তো সেই কবে থেকেই ঘুমোচ্ছে। এ বার আমরাও পণ করেছি, সে ঘুম ভাঙব। এমনটা কিছুতেই চলতে পারে না।’’
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাটি-কারবারের চক্রটা তো স্পষ্ট। ইটভাটা মালিকদের একাংশ সহজে ও কম খরচে মাটি পেতে কাজে লাগাচ্ছে মাফিয়াদের। তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারছে। আর কখনও রাজনৈতিক দাদা, কখনও প্রশাসনিক কর্তাদের প্রশ্রয়ে অবাধে চলছে সেই কারবার।
কিন্তু সেটাই যে একমাত্র ভবিতব্য হতে পারে না, ভরসা সেটাই। তেমন নজিরও আছে। বছর কয়েক আগে ধুবুলিয়ার বাহাদুরপুরে শীতকাল জুড়ে জলঙ্গি নদীর পাড় থেকে মাটি কাটা ছিল রোজনামচা। প্রশাসনকে বহু বার জানানোও হয়েছিল। কিন্তু বলাই বাহুল্য, প্রশাসন হাজারও কাজের ভিড়ে এই ‘সামান্য ব্যাপারে’ নজর দেওয়ার সময় পায়নি। নিরুপায় হয়ে মাটি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন একদল স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া। তাতে পিছু হঠতে বাধ্য হয় এলাকার ওই মাফিয়ারা।
মাটি কাটা শেষ হলে গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঝড়ের বেগে ভাটার দিকে পাড়ি দেয় একের পর এক মাটি বোঝাই ট্রাক্টর। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ধুলোর দাপটে রাস্তা লাগোয়া বাড়িতে শিকেয় ওঠে রান্নাবান্না। স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও ফল না মেলায় হেঁশেল ছেড়ে রাস্তায় নামেন রেজিনগরের মাঙ্গনপাড়ার মহিলারা। আটকে রাখেন মাটি বোঝাই খান দশেক ট্রাক্টর। খবর পেয়ে প্রশাসনের কর্তারা ছুটে এসে কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেন। বেশ কিছু দিন সে রাস্তায় আর ধুলোঝড় ওঠেনি।
নদিয়া কিংবা মুর্শিদাবাদের প্রায় সব নদীর পাড় থেকেই যে ভাবে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নদী বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, নদীর পাড় থেকে মাটি কাটার ফলে নদীর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বদলে যেতে পারে নদীর গতিপথ। যে কোন সময় নদীর পাড় ভাঙতে শুরু করবে। উর্বরতা হারাবে নদীর পাশের জমিগুলো। বাড়বে বন্যার সম্ভবনাও।
বেআইনি ভাবে নদী থেকে মাটি কাটার বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে তেহট্টের রানিনগরের একটি সংস্থা। সেই সংস্থার সম্পাদক বিনায়ক বিশ্বাস বলছেন, “মাটি কাটার বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত অভিযোগ জানানো হয়। মাঝে কিছু দিন বন্ধ থাকে। তারপর ফের যে কে সেই। তবে আমরাও হাল ছাড়িনি। পণ করেছি, এর শেষ দেখেই ছাড়ব।’’
দিনের পর দিন চোখের সামনে থেকে লুঠ হয় জলঙ্গি ও ভৈরবের পাড়। অথচ কেউ দেখেও দেখে না। ব্যাপারটা সহ্য করতে পারেননি ইসলামপুর ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি শঙ্কর মণ্ডল ও তেহট্টের চিকিৎসক প্রলয় ভট্টাচার্য। তাঁরা দু’জনেই তৈরি করে ফেলেন জলঙ্গি ও ভৈরব বাঁচাও কমিটি। ইতিমধ্যে তাঁরা বেশ কয়েকটি পথসভা, সচেতনতা শিবিরও করেছেন। প্রলয়বাবু ও শঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘জানি, এটাই যথেষ্ট নয়। আরও অনেক কিছু করতে হবে। তবুও নদীটাকে এ ভাবে মরে যেতে দেব না!’’
ভাগ্যিস, কিছু মানুষ আজও এমন পণ করেন।
(শেষ)