যন্ত্রের কেরামতি।—নিজস্ব চিত্র
ফেলো কড়ি, তোলো বাড়ি!
না হলে ভরা বর্ষায় সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা। নালা উপচে ঘরে ঢুকে পড়ে নোংরা জল। তাই বাড়িটাকেই ফুট তিনেক উঁচু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বহরমপুরের গোরাবাজার নিরুপমাদেবী রোডের বাসিন্দা তারিক আহমেদ।
খরচ, তা মন্দ নয়। স্কোয়্যার ফুট পিছু ২৫০ টাকা পড়বে প্রায় ১০৫০ স্কোয়্যার ফুটের বাড়িটাকে সাড়ে তিন ফুট উঁচু করতে।
কিন্তু হঠাৎ এমন পরিকল্পনা কেন? মুর্শিদাবাদ জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক কার্যালয়ের করণিক তারিক জানান, আগে গোরাবাজার চত্বরে একটি বাড়ি ভাড়া করে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকতেন। খোঁজ পান, নিরুপমাদেবী রোডের ওই বাড়িটা বিক্রি হচ্ছে। দেরি না করে গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে কিনেও ফেলেন। সে প্রায় দেড় বছর হয়ে গিয়েছে। ‘‘কিন্তু তখন তো আর টের পাইনি, বর্ষার সময় এমন দুর্ভোগ কপালে নাচছে। বৃষ্টি মানেই জল জমা। আর তার পর চৌকাঠ টপকে ঘরময় নালার জল থইথই,’’ বললেন তারিক।
বলে চললেন তারিক, ‘‘গত বছর বর্ষায় শোওয়ার ঘরেও জল ঢুকে যায়। রান্নাঘর, বাথরুমে গোড়ালি ছাপিয়ে জল। অগত্যা জলে পা দিয়েই এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত। গা ঘিনঘিন করতো। এ দিকে খাটের উপরে আড়াই বছরের ছটফটে নিহাদকে সামলে রাখা দায়! একরত্তি ছেলে তো অত সব বোঝে না। জলের মধ্যে নেমে ছপাৎ ছপাৎ করে খেলা করার ইচ্ছে।’’ এ হেন করুন অবস্থা থেকে বাঁচতেই বাড়ি উঁচু করার সিদ্ধান্ত নেন তারিক।
যদিও ব্যাপারটা এত সহজ হয়নি। বেঁকে বসেছিলেন তারিকের স্ত্রী, পেশায় স্কুলশিক্ষিকা নাজমা খাতুন। তাঁর ভয় ছিল, বাড়ি উঁচু করতে গিয়ে যদি গোটা বাড়িটাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে! তারিকবাবু বলেন, ‘‘স্ত্রীকে অনেক করে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ি উঁচু করার বরাত দিই হরিয়ানার একটি সংস্থাকে।’’
বাড়ি উঁচু করার সিদ্ধান্তের পিছনে আরও একটা জোর আছে। তারিক বলেন, ‘‘কৃষ্ণনগরে বাড়ি উঁচু করার খবর পড়েছিলাম সংবাদপত্রে। শান্তিপুরে নাকি বাড়ি এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ সব পড়েই মনে হয়েছিল, যদি নিজের বাড়িটাও একই পদ্ধতিতে উঁচু করা যায়, কেমন হয়!’’ তারিক জানালেন, মাথার মধ্যে ঘুরপাক করছিলই চিন্তাটা। তার পরে রাত জেগে ইন্টারনেট ঘেঁটে, বিভিন্ন বাস্তুকারের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়ি উঁচু করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন।
দিন পনেরো হল কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। হরিয়ানার ওই সংস্থার পক্ষ থেকে কাজকর্ম দেখভালের জন্য রয়েছেন অরুন কুমার। বললেন, ‘‘এর আগেও হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, চেন্নাই, কেরল, হায়দরাবাদ, রাজস্থানে বাড়ি উঁচুর কাজ করেছি। কিন্তু বহরমপুরে এই প্রথম আসা।’’ অরুনের দাবি, তাঁদের সংস্থা গুরগাঁওয়ের একটা দোতলা দোকানঘর প্রায় সোয়া ১১ ফুট উঁচু করেছে। একটি দোতলা বাড়ি এক জায়গা থেকে সাড়ে চারশো ফুট দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে রের্কড গড়েছে তাদের সংস্থা।
এ দিকে বাড়ি উঁচু করা দেখতে ভিড় উপচে পড়ছে পাড়া-প্রতিবেশীদের। তারিকের সহকর্মীদের অনেকেও গোটা বিষয়টি সরজমিনে খতিয়ে দেখতে ভিড় করছেন নিরুপমাদেবী রোডের বাড়িতে। এমনই এক সহকর্মী যেমন ওয়াসিম রেজা বললেন, ‘‘প্রযুক্তির সাহায্যে একটা গোটা বাড়ি সবশুদ্ধ উঁচু হয়ে যাবে! তাজ্জব বনে গেলাম।’’
লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাড়ি উঁচু করা অবশ্য সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এ বারের বর্ষাতেও ভাসতে হবে অনেককে। স্থানীয় বাসিন্দা আবু বক্কর যেমন বলেন, ‘‘এই জায়গায় আগে জলাজমি ছিল। ১৫ বছর আগেও ধান চাষ হত। ব্যবসার উদ্দেশ্যে কয়েক কাঠা জমি কিনে রেখেছিলাম। পরে সকলেই বাড়ি করছে দেখে আমিও বাড়ি করি। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু জল জমে যায়।’’বিষয়টি অবশ্য পুরসভার অজানা নয়। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের স্থানীয় কাউন্সিলর কংগ্রেসের গোপাল সিংহ বলেন, ‘‘আগে ৩০ মিনিটের মধ্যে জল নেমে যেত। কিন্তু এখন জল নামতে তিন ঘন্টাও লেগে যায়। টানা কয়েক দিন বৃষ্টি হলে, ওই এলাকার বাসিন্দাদের বাড়িতে থাকা সত্যিই খুব কষ্টের।’’
সমাধানের পথ কী? কাউন্সিলর জানান, ওই এলাকার জল গোবর্ধন নালা ও বিবিগঞ্জ নালা দিয়ে শহরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে চালতিয়া বিলে পড়ার কথা। কিন্তু এখন চালতিয়া বিল মজে যাওয়ায় তার জলধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। গোবর্ধননালার মুখ বন্ধ হয়ে গিয়ে জল ব্যাক-ফ্লো হয়ে ফের ওই এলাকায় ঢুকে পড়ছে। ফলে সমস্যা বাড়ছে।’’
পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, ‘‘ওই দু’টি নালা সেচ দফতরের অধীনে। বর্তমানে সেচ দফতর বিভিন্ন নালা সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু ওই দু’টি নালা সংস্কারের কথাও রয়েছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদের সভাধিপতির সঙ্গে বৈঠক করে ওই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’’