‘‘দিনপাঁচ-ছয় পরে একদিন সকাল-বেলা বাটীর পুরাতন নাপিত, যাদবের ক্ষৌর-কর্ম্ম করিয়া উপর হইতে নামিয়া যাইতেছিল, অমূল্য আসিয়া তাহার পথ রোধ করিয়া বলিল, কৈলাসদা, নরেনদার মত চুল ছাঁটতে পার?
নাপিত আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, সে কি রকম দাদাবাবু!
অমূল্য নিজের মাথার নানাস্থানে নির্দ্দেশ করিয়া বলিল, দেখ, এইখানে বার আনা, এইখানে ছ আনা, এইখানে দু আনা, আর এই ঘাড়ের কাছে এক্কেবারে ছোট ছোট। পারবে ছাঁটতে?
নাপিত হাসিয়া বলিল, না দাদা, ও আমার বাবা এলেও পারবে না।
অমূল্য ছাড়িল না। সাহস দিয়া কহিল, ও শক্ত নয় কৈলাসদা, এইখানে বার আনা, এইখানে ছ আনা—
.... নাপিত চুল কাটিতে লাগিল। বিন্দু চোখ টিপিয়া দিল। সে সমস্ত চুল সমান করিয়া কাটিয়া দিল।...’’
—বিন্দুর ছেলে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তার পরে সময় গড়িয়েছে ঢের। কিন্তু অমূল্যেরা বদলায়নি। অন্য রকম কিছু একটা দেখলেই তারা সেটাকেই নকল করতে চায়। নায়ক কিংবা খেলোয়াড়দের চুলের মতো চুল কাটার প্রবণতাও তো আজকের নয়। নাপিতের কানে কানে মিঠুন কিংবা অমিতাভ ছাঁটের কথা কত জন যে বলতেন তার ইয়ত্তা নেই। কানে কানে কেন? ফরাক্কার এক যুবক বলছেন, ‘‘কানে কানে না বললেই তো বড়রা শুনতে পেয়ে যেত। শুনতে পেলেই কানে পড়ত মোক্ষম টান।’’
কখনও নাপিতকে ও ভাবে চুল কাটতে দেখলেই বাড়ির বড় কেউ দাঁড়িয়ে পড়তেন। আর তার পরেই হুঙ্কার, ‘‘খুব বড় হয়ে গিয়েছিস না? ও কাকা, ওর চুল একদম ছোট ছোট করে কেটে দেবে। আর তুই বাড়ি আয়। তোর মিঠুন হওয়া দেখাচ্ছি।’’
তা হলে কী দাঁড়াল? মিঠুন ছাঁট তো হলই না, উল্টে সেই ছাঁটের ইচ্ছা প্রকাশ করাতেই বিপত্তি। তাই তখনও নাপিতেরা ছোটদের অনুরোধে চুল কাটতে ইতস্তত করতেন। ছোটদের বায়না মেটালে বড়দের কাছে যে তাঁকেও বকুনি খেতে হত!
বাড়ির উঠোনে চেয়ারে বসে থাকতে বয়স্ক কেউ। টুলের উপর বসে বাড়ির ছোট সদস্য। বাড়িতে এসে নাপিত চুল কাটতেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রাধাগোবিন্দ মণ্ডলের বাঘা গ্রামে এখনও তেমন নাপিত আছেন। খবর পাঠালে ৬৫ বছরের প্রবোধ প্রামাণিক আজও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল কেটে দিয়ে আসেন।
বছর দশেক আগেও একই ছবি ছিল বাড়ালা গ্রামেও। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ পরেশ সরকার বলছেন, “বড় গ্রাম। নাপিত এসে সকালেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ নিতেন, কেউ চুল দাড়ি কাটবেন কি না। নগদ টাকা নয়, চুল-দাড়ি কাটার বিনিময়ে বছর শেষে তাঁরা চাল বা ধান পেতেন। এখন তো সময় বদলে গিয়েছে। আমাদের গ্রামেই এখন রমরমিয়ে চলছে সাতটি সেলুন।’’
শমসেরগঞ্জের চাঁদপুর বাজারে একসময় ইটের উপর বসিয়ে চুল কাটাই ছিল দস্তুর। গাছতলায় জনা তিনেক নাপিত গিয়ে নিয়মিত বসতেন। ইটের উপর বসে চুল কাটতে হত বলে অনেকেই মজা করে বলতেন, ইটালিয়ান সেলুন!
এলাকার প্রবীণেরা বলছেন, ‘‘তখন দুষ্টুমি যেমন ছিল, তেমনি শাসনও ছিল। এখন তো সবই বদলে গিয়েছে! দুষ্টুমি বেড়েছে। কিন্তু শাসন করবে কে?’’ সম্প্রতি নিউ ফরাক্কা হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়েছেন— ‘আগামী ৮’ই অগস্ট নাপিত ভাইদেরকে নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সভার আয়োজন করা হয়েছে।’
এমন নোটিসের নেপথ্যে রয়েছে পড়ুয়াদের অদ্ভুত সব চুলের ছাঁট। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোনিরুল ইসলাম সদ্য এই স্কুলে এসেছেন। আর এসেই পড়ুয়াদের চুলের বাহার দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! তিনি বলছেন, ‘‘এ সব কি ছাত্রসুলভ চুলের ছাঁট, বলুন তো? আমি ওদের দিন পনেরো সময় দিয়েছিলাম। কেউ কথা শোনেনি। তাই এলাকার নাপিত ভাইদের ডেকে পাঠিয়েছি। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে অনুরোধ করব, এ ভাবে যেন তাঁরা চুল না কাটে।’’ বহু অভিভাবকও শিক্ষকদের সঙ্গে একমত। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমাদের কথা শোনে না। এ বার স্কুলের ভয়ে যদি মানুষ হয় তো হবে।’’
নিউ ফরাক্কা স্কুলের পাশেই রামশঙ্কর ঠাকুরের সেলুন। তিনি বলছেন, ‘‘ছাত্রেরা মোবাইল থেকে মেসি, রোনাল্ডো, বিরাটদের ছবি দেখায়। আমরা সে ভাবেই চুল কেটে দিই। এখন আমরা পড়েছি বড় ফ্যাসাদে। ওদের কথা না শুনলে ওরা রাগ করে। আবার কথা শুনলে বড়রা রেগে যান!’’