এনআরসি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ফাইল চিত্র
এত দিন সে ভাবে খোঁজ পড়েনি। খোঁজ করার দরকারও হয়নি। এ বার সেই ‘অবহেলিত’ কিংবা ‘হারানো’ নথির খোঁজেই দিনরাত এক করে ফেলেছেন হরিহরপাড়া এলাকার বহু মানুষ। কেউ ছুটছেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে তো কেউ হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছেন স্থানীয় বিডিও অফিসে।
এ ভাবেই হরিহরপাড়ার সলুয়া গ্রামের চাষি গিয়াসউদ্দিন শেখও (৫৮) গত কয়েক দিন ধরেই হন্যে হয়ে সরকারি অফিসে চরকিপাক দিচ্ছিলেন। আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও জমির রেকর্ড চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সব খুঁজে না পেয়ে তিনি একপ্রকার নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেন। তার পরে বৃহস্পতিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর পরিবারের দাবি, নথিপত্র খুঁজে না পেয়ে এনআরসি আতঙ্কেই মারা গিয়েছেন ওই প্রৌঢ়।
মৃত গিয়াসউদ্দিনের বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। শুক্রবারেও বাড়িতে উনুন জ্বলেনি। পাড়ার মাচায় বসে গিয়াসউদ্দিনের বাল্যবন্ধু মহসিন শেখ বলছিলেন, ‘‘কয়েক দিন ধরেই খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল গিয়াস। মসজিদে নমাজ পড়তে গিয়ে হোক, বা জমিতে কাজে গিয়ে সব সময়ই সে শুধু ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলত। আর সেই ভয়েই দেশ ছাড়ার আগেই তো ও দুনিয়া ছেড়েই চলে গেল।’’
২০০০ সালের বন্যায় ভেসেছিল মুর্শিদাবাদের বহু এলাকা। বানভাসি হয়েছিল হরিহরপাড়াও। বানের জলে বহু কিছুর সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা রজব আলি বলছেন, ‘‘সে বার বানের সময় জান বাঁচানোটাই ছিল বড় কথা। কাগজপত্রের খোঁজ সত্যিই রাখা হয়নি। এখন আমরাও সে সব খুঁজে বেড়াচ্ছি।’’
গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন শেখও মানছেন, ‘‘গ্রামের অনেকেরই দরকারি কাগজপত্র নেই। সবাই এখন কাজকর্ম ফেলে সরকারি অফিস আর বাড়ি করছি।’’ গ্রামের আর এক বাসিন্দা মাসাদুল ইসলাম বলেন, ‘‘অসমের নাগরিক পঞ্জি ঘোষণার পরে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। সেই ভয়ের কাছে হেরে গিয়ে ডোমকলের মিলন মণ্ডল, আমাদের গ্রামের গিয়াসউদ্দিন মারা গেল। সকলেই এখন নথিপত্র জোগাড় করতে মরিয়া।’’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বন্যার পরে গ্রামের বাসিন্দারা ভোটার কার্ড, আধার কার্ড তৈরি করতে পারলেও অনেকেই জমির দলিল, রেকর্ড সংগ্রহ করতে পারেননি। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সাইদুল শেখ বলছেন, ‘‘বিএলআরও অফিসে এখন খুব ভিড়। কারও নামে গন্ডগোল রয়েছে, কেউ নথি সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন।’’
শুক্রবার সকালে গিয়াসউদ্দিন শেখের বাড়িতে যান রাইপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান জানারুল শেখ। ওই পরিবারকে সমব্যথী প্রকল্প থেকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়।
জানারুল বলছেন, ‘‘মানুষকে বোঝাচ্ছি, এনআরসি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওঁরা যাতে নথিপত্র জোগাড় করতে পারেন তার জন্য তদ্বির করা হবে।’’ ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরাও আশ্বস্ত করছেন, ‘‘নথি হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে থানায় জিডি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে নথির জন্য আবেদন করতে হবে। এর জন্য আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’’