—প্রতীকী চিত্র।
ঠিক যেন শুটিং চলছে!
তবে এ শুটিং কিঞ্চিৎ আলাদা। এখানে কেউ লাইট, ক্যামেরা বলে না। ‘কাট, কাট’ চিৎকার করে কোনও খুঁতখুঁতে পরিচালক মাঝপথে থামিয়ে দেয় না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অ্যাকশন, অ্যাকশন আর অ্যাকশন।
নিখুঁত চড়। নিটোল থাপ্পড়। নির্ভেজাল লাথি। মারের পর মার। আবার মার। প্রথমে ছেলেটি হাতজোড় করে কিছু বলতে চায়। কেউ শোনে না। নাকের উপরে আছড়ে পড়ে বেমক্কা ঘুসি। টাল সামলে ছেলেটি বলার চেষ্টা করে, ‘বিশ্বাস করুন, আমি...।’
কথা শেষ না হতেই ফের শুরু হয় ‘পাবলিকের মার’। ছেলেটির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত। দু’টো ভাঙা দাঁত চাপা পড়ে যায় কারও ভারী জুতোর নীচে। কিছুক্ষণ পরেই সেই জুতো উঠে পড়ে পড়ে থাকা ছেলেটির মুখের উপর। সিগারেটের শেষাংশের মতো পিষে যায় ছেলেটির মুখ, চোখ, কপাল, ভুরু।
ছেলেটির কথা বলার ক্ষমতা নেই। ফের হাত তুলে ইশারায় বলতে চায় কিছু। ঠিক তখনই কেউ বলে, ‘মার, মার, ওইখানে মার।’ নাগাড়ে লাথি পড়ে পাঁজরে, তলপেটে, যৌনাঙ্গে। ছেলেটি কঁকিয়ে ওঠে। তার পরে কেমন চুপ মেরে যায়।
চারপাশে জোর হল্লা। বেড়ে একটা পড়ে পাওয়া মজার আবহ। যে মার খাচ্ছে সে একা। তার প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। রুখে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। ফলে যারা মারছে তাদের ভারী আমোদ।
এ ভাবে হাত খুলে মারার সুযোগ কি আর সব সময় মেলে? পাবলিক একটা করে ঢিসুম ছুড়ছে। আর জন্মদাগ সমতুল ইগো-সিস্টেমে ইকো হচ্ছে— ঢিসুম, ঢিসুম, ঢিসুম...।
যেখানে ছেলেটা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে সেখানে তার কোনও আত্মীয় নেই। স্বজন নেই। বন্ধুও নেই। সবাই শত্রু। সবাই তাকে মারতে চায়। বাকিরা দেখতে চায়। কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না।
কেন? ছিটকে আসে হরেক কিসিমের উত্তর
—‘চুরি করতে এসেছিল।’
—‘ব্যাটা, আস্ত পাগল!’
—‘ছেলেধরা।’
—‘চেহারাটা দেখছেন, পাক্কা ক্রিমিনাল।’
—‘নির্ঘাৎ, নেশা করে।’
অতএব জেগে ওঠে গণ। পাড়া থেকে শুরু করে তামাম বিশ্বকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও বাসযোগ্য করে তোলার জন্য একটাই ওষুধ— মার।
গণসংগঠনে লোক না জুটুক, গণসঙ্গীতে শিল্পী না মিলুক, গণতন্ত্রে আস্থা না থাকুক, গণপিটুনি টানটান মাদারিকার খেল। বেশ লোকজন টানে। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই থিকথিক করে ভিড়।
সবাই আস্তিন গুটোয়। অনেকেই মারে। দর্শকও কম নয়। তবে তারা থাকে একটু নিরাপদ দূরত্বে। চুটিয়ে ‘লাইভ-মার’ উপভোগ করে। আবার থানা-পুলিশ শুরু হওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে সরে পড়ে। সাধ করে কে আর সাক্ষী হতে চায়!
কেস হয়, কলরব হয়, খবর হয়। দু’একজন ধরা পড়ে। তার পরে পিটুনির উপর পিটুনির প্রলেপ পড়তে পড়তে ক্রমশ ধূসর হয়ে যায় থেঁতলানো মুখ, ক্ষতবিক্ষত শরীর।
আজ বহরমপুর, কাল কলকাতা, পরশু আর এক জায়গায়। জনতার শাসন চলতেই থাকে। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে, কোনও যুক্তি-তর্কের পরোয়া না করে, সহানুভূতি- সহমর্মিতা জলাঞ্জলি দিয়ে এই পাশবিক খেলার কোনও বিরাম নেই।
যারা এমন বেধড়ক মার খায়, তারা কেউ মরে বেঁচে যায়। কেউ বেঁচে থেকে একটু একটু করে মরে। সভ্যতা, শিক্ষার মুখে কালি লেপে কিছু পাবলিক ফের খুঁজতে থাকে আরও একটা শিকার।
শুটিং চলতেই থাকে!