ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ফুরিয়ে গিয়েছিল মাছ বিক্রেতার। দরদাম করার পরে মাছ মাপাও হয়ে গিয়েছে।
মাঝবয়সি খরিদ্দার যখন জানতে পারলেন যে ক্যারিব্যাগে মাছ দেওয়া সম্ভব নয়, তৎক্ষণাৎ তিনিও জানিয়ে দিলেন, তাঁর পক্ষেও মাছ কেনা সম্ভব নয়। কারণ, মাছের জন্য তিনি আলাদা কোনও থলে নিয়ে আসেননি।
অগত্যা পাশের বিক্রেতার কাছ থেকে ক্যারিব্যাগ চেয়ে মাছ ভরে দেওয়ার পরে বেজার মুখে তা বললেন খরিদ্দার। তিনি চলে যেতেই বেজার মুখে মাছ বিক্রেতা বলছেন, “আমরা তো ক্যারিব্যাগ ব্যবহার করতে চাই না। কিন্তু তাতে ব্যবসাই লাটে ওঠবে।”
এই ছবি কৃষ্ণনগর শহরের সবচেয়ে বড় বাজার পাত্র বাজারের ছবি। অন্য সব বাজারেও একই চিত্র। তা সে মাছের বাজার হোক বা আনাজের বাজার।
কিন্তু এই ছবিটা পাল্টাতে চলেছে, অন্তত তার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আজ, ১৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার থেকে কৃষ্ণনগর শহরে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ও কৌটো ইত্যাদি, থার্মোকলের থালা-বাটি-গ্লাস ইত্যাদি নিষিদ্ধ করছে পুরসভা। নিয়ম ভাঙলেই জরিমানা!
কিন্তু সত্যিই কি কার্যকর করা যাবে নিয়ম? বিশেষত আমজনতাই যখন এ নিয়ে অসচেতন? রাস্তার পাশে আনাজ সাজিয়ে বসে থাকা এক মহিলা বিক্রেতা বলেন, “সামান্য লঙ্কা নেবে, তার জন্যও ক্যারিব্যাগ চাই! যাঁরা ক্যারিব্যাগ চান, তাঁরা কিন্তু সব শিক্ষিত মানুষ। তাঁরাই বাধ্য করেন ক্যারিব্যাগ দিতে। না হলে অন্য দোকানে চলে যান।”
সকালে বাজরে গেলেই বোঝা যায়, কী ভাবে ক্যারিব্যাগ জনতার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফলে তা বন্ধ করা যে সহজ কাজ নয়, তা বিলক্ষণ জানেন পুরসভা কর্তৃপক্ষ। সেই কারণে তাঁরা এ বিষয়ে কোনও রকম তাড়াহুড়ো করতে চাননি। তাঁরা চেয়েছেন, প্রথমে মানুষকে নানা ভাবে সচেতন করতে। সেই মতো প্রায় তিন মাস ধরে শহরের বুকে নানা ভাবে প্রচার অভিযান চলেছে। এর আগে নাগরিক কনভেনশনের আয়োজন করেছে কৃষ্ণনগর পুরসভা। সেখানেই মত উঠে আসে যে, শুধু প্রচার করে হবে না, পুর কর্তৃপক্ষকে কড়া অবস্থান নিতে হবে। সেই কনভেনশনেই ঠিক হয়, ক্যারিব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে ১৭ অক্টোবর থেকে জরিমানা করবে পুরসভা। এত দিন ধরে চলেছে প্রচার। আজ, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে আইনি পদক্ষেপ।
রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভা আগেই শহরকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে পদক্ষেপ করলেও এত দিন কৃষ্ণনগর পুরসভার বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি। এ বার ছ’টি বিশেষ নজরদার দল তৈরি করা হয়েছে, যারা শহরের বুকে নিয়মিত অভিযান চালাবে। ক্রেতা-বিক্রেতা যে-ই যাঁর কাছেই ক্যারিব্যাগ পাওয়া যাবে, তাঁকেই জরিমানা করা হবে। শুধু ক্যারিব্যাগ নয়, সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে থার্মোকলের থালা, প্লেট, বাটি ও গ্লাস। নিষিদ্ধ হচ্ছে প্লাস্টিকের পাত্রও। মিষ্টির দোকান বা রেস্তোরাঁও সে সব ব্যবহার করতে পারবে না। চায়ের দোকানে চলবে না প্লাস্টিকের কাপ।
পুর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে কৃষ্ণনগর শহরের ১৬ জন ক্যারিব্যাগ, প্লাস্টিকের পাত্র ও থার্মোকলের থালা-বাটির পাইকারি ব্যবসায়ীকে চিঠি দিয়ে ১৭ অক্টোবরের পর তাদের সামগ্রী বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। সেই সঙ্গে মাছ বা আনাজের বাজার, বড় কাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান এমনকি পাউরুটির বেকারিগুলিকেও প্লাস্টিক ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। প্লাস্টিকের পরিবর্তে চট, পাট, কাগজ বা যে কোনও পচনশীল উপকরণ দিয়ে তৈরি ব্যাগ বা ঠোঙা ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। খাবারের দোকান, মিষ্টির দোকান ও রেস্তোরাঁগুলিকে কাগজের বাক্স ও মাটির পাত্র ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। অনুষ্ঠান বাড়িতে থার্মোকলের পাত্র বাদ দিয়ে মাটির থালা, শালপাতা বা কলাপাতা ও মাটির পাত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে পুরসভা।
কিন্তু প্লাস্টিক বা থার্মোকল ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেলে যে বিকল্প উপকরণের চাহিদা তৈরি হবে, তার জোগান হঠাৎ আসবে কোথা থেকে? শালপাতা বা কলাপাতার জোগান না-হয় হল, কিন্তু মাটির পাত্র?
কৃষ্ণনগর শহরের বাসিন্দা পঙ্কজ সরকারের মতে, “জিনিসটা শুনতে যতটা ভাল লাগছে, বাস্তবে করা কিন্তু কঠিন। কারণ এখন আর সে ভাবে কোনও পরিবার কাগজের ঠোঙা তৈরি করে না। যে সব কুমোরেরা মাটির পাত্র তৈরি করতেন, চাহিদা না-থাকায় তাঁদের অনেকেই কিন্তু পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত না এই কারণেই সব ভেস্তে যায়!”
কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাসক কথা পুরসভার প্রশাসক বোর্ড চেয়ারম্যান সৌমেন দত্ত অবশ্য বলছেন, “বিষয়টা মাথায় ছিল বলেই আমরা মাটির পাত্র তৈরি করে এমন গ্রামে গিয়ে কুমোরদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, জোগানে কোনও সমস্যা হবে না। বরং যেহেতু এক সঙ্গে অনেকটা বিক্রি হবে, তাই তাঁরা কম দামেও পাত্র দিতে পারবেন।”
বছর কয়েক আগেই এক বার শহরে ক্যারিব্যাগ বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল কৃষ্ণনগর পুরসভা। কিন্তু অভিযান চলাকালীন পাত্রবাজারের মাছের বাজারে পুরকর্মীদের দিকে বঁটি নিয়ে তেড়ে এসেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ বার যাতে তেমনটা হতে না পারে, তার জন্য আগে থেকেই পুলিশকে সতর্ক করেছেন কর্তৃপক্ষ। গত ২ অক্টোবর জেলাশাসক নিজে পুলিশ নিয়ে বিভিন্ন বাজারে গিয়ে প্রচার করেছেন। প্রচার চালিয়েছেন প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা অন্যতন প্রশাসক অসীম সাহাও। তাঁর কথায়, “আমরা পুরসভার তরফে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রয়োজন নাগরিকদের সহযোগিতা। আশা করছি, পরিবেশের কথা ভেবে তাঁরা আমাদের পাশে থাকবেন।”