ট্রেন ধরতে শিকেয় উঠল দূরত্ব বিধি। বুধবার চাকদহ স্টেশনে। ছবি: প্রণব দেবনাথ
‘অনুগ্রহ করে শুনবেন…।’
কার্তিকের শেষ রাতে মাইকের গমকে চমকে উঠেছিল প্রায় জনশূন্য নবদ্বীপ ধাম স্টেশন। কত দিন পর আবার সেই চেনা স্বর! ট্রেন আসছে। পাক্কা ২৩৪ দিন পর। প্ল্যাটফর্মে ঝোলা ডিজিটাল ঘড়িতে তখন সওয়া চারটে। কিন্তু যাঁদের নিতে আসছে ট্রেন, তাঁরা কই? কোথায় প্ল্যাটফর্ম জুড়ে থোকা থোকা জটলা। ঝলমলে আলোয় বড় বেশি খাঁ খাঁ শূন্যতা।
প্রায় আট মাস পর প্রথম ট্রেন এল। কিন্তু তেমন কাউকে ওঠানামা করতে দেখা গেল না। রেলকর্মী, আরপিএফ, রেলপুলিশই বরং দলে ভারী। প্রথম ট্রেনের যাত্রীদের মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির নিত্যযাত্রী সমিতির সদস্যেরা। সকলেই অবাক।
অনেকে ভেবেছিলেন, বেলা বাড়লে ভিড় বাড়বে। কিন্তু ভোর থেকে ভরদুপুর। ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনে একটার পর একটা ট্রেন এসেছে, লোক বাড়েনি। অফিস টাইমের ট্রেনও ছিল ফাঁকা-ফাঁকা। বস্তুত হাওড়া লাইনের সার্বিক ছবিটাই ছিল এ রকম।
কিন্তু শিয়ালদহ লাইনের ছবি অনেকটাই আলাদা। কৃষ্ণনগরে যদিও বা সাধারণ দিনের চেয়ে ভিড় অনেকটাই কম ছিল, দক্ষিণের দিকে ট্রেন যত এগিয়েছে তত লোক বেড়েছে। সকালের প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে ট্রেনে বেড়েছে ঠাসাঠাসি। চিহ্নিত আসন ছাপিয়ে সব আসনেই বসে পড়েছেন যাত্রীরা। অনেকেই দাঁড়িয়ে থেকেছে। চাকদহ, রানাঘাট, কল্যাণী সর্বত্র চোখে পড়েছে এই দৃশ্য। রানাঘাটে এসে পৌঁছনো গেদে লোকাল তো প্রায় পুরনো স্মৃতিই মনে পড়িয়ে দিয়েছে। তবে ট্রেনে ওঠার জন্য মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হবে বলে যে আশঙ্কা ছিল, সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি বিষয়টা। এমনকি যে হকারেরা মঙ্গলবার পর্যন্ত ট্রেনে উঠবেনই বলে গোঁ ধরেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই এ দিন দেখা যায়নি। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছে সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে ফেরার সময়েও।
এই যদি প্রথম দিনের ছবি হয়, একটু সড়গড় হয়ে আগামী সপ্তাহ থেকে ভিড়ের পুরনো চেহারা ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা। কৃষ্ণনগর-কালীনারায়ণপুর ডেলি প্যাসেঞ্জার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সৌমাভ চৌধুরীর মতে, “প্রথম দিন ট্রেনে খুব ভিড় হবে, এই আশঙ্কায় অনেকেই আসেননি। একটু দেখে নিয়ে সোমবার থেকে আসবেন হয়তো।” হাওড়া-কাটোয়া সুবার্বন প্যাসেঞ্জার অ্যাসসিয়েশেনের সৌমেন অধিকারীও বলছেন, “সোমবার থেকে ছবিটা বদলে যেতে পারে।”
মণ্ডলহাটের এক বাসিন্দা জানান, এ দিন থেকেই ট্রেন স্বাভাবিক ভাবে চলবে সেটা তাঁরা অনেকেই বুঝতে পারেননি। অনেকের আবার ট্রেনে চড়ার প্রয়োজনও আপাতত নেই। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাসের কথায়, “কাজ নেই, ব্যবসার মোকাম খোলেনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। লোকে কি বেড়াতে যাবে?”
চাকদহের বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের অমল পাল কলকাতায় একটি বিস্কুট কারখানার অস্থায়ী কর্মী ছিলেন। লকডাউনের আগে রোজ সকালে ট্রেন ধরতেন। তাঁর চাকরিটি আর নেই, তাই ট্রেনে চড়ারও দরকার নেই। এ রকম কত মানুষ আছেন, কে জানে!