এ বার রথ নামবে না রাস্তায়। কৃষ্ণনগর রথতলার রাজবাড়ির রথ। সোমবার। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
রথের দিন নদিয়ার প্রাচীন জনপদের গলি থেকে রাজপথে দেখা মেলে একাধিক রথের। সময়ের রথে চড়ে এদের কেউ পেরিয়ে এসেছে তিনশো, দু’শো বা শতবর্ষের সুদীর্ঘ পথ। কোনও রথ সে কালের কোন জমিদার বাড়ির উদ্যোগে চালু হয়েছিল। কোনও রথের প্রচলন করেন ভিন্ রাজ্যের রাজকন্যা। কোনও রথের যাত্রা শুরু বৈষ্ণব সাধুর হাতে। কোনও রথ আবার ও-পার বাংলায় যাত্রা শুরু করে এসে পৌঁছে গিয়েছে চৈতন্যধামে। কোনও রথ কেবলমাত্র সন্ন্যাসিনীদের। জগন্নাথ বাড়ির বালক সাধুর রথ, মণিপুর রাজকন্যা পরম বৈষ্ণব বিম্বাবতি মঞ্জরী দেবী ইচ্ছায় মণিপুর রাজবাড়ির রথ, দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের রথ, সারদেশ্বরী আশ্রমের সন্ন্যাসিনীদের রথ-তালিকা দীর্ঘ। আবার, কিছু রথের চাকা আর গড়ায় না। চিরকালের জন্য গতি হারিয়ে বসেছে প্রভু জগন্নাথ।
বড়গোস্বামী বাড়ির রথ
শান্তিপুরের ঐতিহ্যবাহী এই রথ চলছে আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে। অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী পরবর্তী সময়ে এই রথের যাত্রা শুরু। ব্যতিক্রমী ওই রথের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকেন সুবিশাল রঘুনাথ বিগ্রহ। অনেকে তাই একে রঘুনাথের রথও বলেন। সঙ্গে থাকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। কম-বেশি চল্লিশ ফুট উচ্চতার লোহার ছয় চাকার ওই রথ এক সময়ে বড় গোস্বামী বাড়ি থেকে মাতালগড় পর্যন্ত যেত। তবে এখন সেই রথের যাত্রাপথ কমে আগমেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত যায়। তবে প্রথাগত ভাবেই মাসির বাড়ি অন্য কোথাও নয়, হয় মন্দিরের অন্য অংশে। এ বার ভক্তদের কোলে চড়ে জগন্নাথ নিজ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি যাবে।
গোকুলচাঁদের রথ
শান্তিপুর মধ্যম গোস্বামী পরিবারের ওই রথও তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলছে। শান্তিপুর বড়বাজার রথতলার ‘রথের সরান স্ট্রিট’ ধরে চলে এই রথ। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার লোহার রথ ঘিরে মানুষের বিপুল আগ্রহ। ভারী ওই রথ অবশ্য সুদূর অতীত থেকেই সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করে। এ বছর তা-ও হবে না। এই রথেও জগন্নাথ দেবের সঙ্গে থাকে রামচন্দ্র। শান্তিপুরের গোপালপুর সাহাবাড়ি রথও খুব প্রাচীন। রামচন্দ্রের সঙ্গে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবীর সেই রথ ঘিরে স্থানীয় মানুষের উৎসাহের শেষ নেই।
পতিতপাবন জগন্নাথের রথ
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই নদিয়ায় চলে আসেন শ্রীহট্টের বিদগ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এবং উইমেন্স কলেজের বিভাগীয় প্রধান রসরঞ্জন গোস্বামী। তিনি পত্তন করেন রাধা সুদর্শন মন্দির। তাঁরই আমলে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা। তবে জগন্নাথ নয়, রথে চড়ে বের হত রাধারমন। কিছুকাল বন্ধ থাকার পর ফের নবদ্বীপের রাস্তায় চলছে সেই রথ। তবে ব্যতিক্রমী সেই রথে এখন আরোহণ করে পতিতপাবন জগন্নাথ। কয়েক কুইন্টাল ওজনের সেই বিগ্রহ অন্য বার পাঁচ কিলোমিটার যাত্রা করলেও এ বার মন্দিরে পাঁচ ফুট যাত্রা করেই নিয়মরক্ষা করবে।
মণিপুর রাজবাড়ির রথ
মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর পুত্র কুমার চৌরজিৎ সিংহ এই রথের সূচনা করেছিলেন। ১৮০৫ সাল থেকে প্রায় সওয়া দু’শো বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন চলেছে রাজবাড়ির রথ। মণিপুরের নিজস্ব ঘরানায় এই রথযাত্রা এই প্রথম বন্ধ হল। চোদ্দো ফুট উচ্চতার পিতল এবং কাঠের তৈরি রথ লাল কাপড় আর জুঁইয়ের মালায় সেজে পথে নামে আষাঢ় সন্ধ্যায়। মণিপুরের নিজস্ব রীতি মেনে এখানে জগন্নাথের মাসির বাড়ি নেই। উল্টোরথ পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় হয় মণিপুরী নাচ। গাওয়া হয় জয়দেবের পদ। তবে এ বারে রথ সাজানোই হবে না। নাটমন্দিরে পুজোপাঠ করা হবে জগন্নাথ দেবের।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রথ
পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও মনে করা হয়, মহারাজ গিরিশচন্দ্র এই রথের প্রবর্তক। আঠারো শতকের প্রথম অর্ধ জুড়ে তাঁর রাজত্বকালের শুরুর দিকে কোনও এক সময়ে রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল। রাজবাড়ির রথের বিশিষ্টতা হল প্রথাগত ভাবে জগন্নাথ নন, কূলদেবতা গোপীনাথ ওই রথে চড়ে। পরবর্তী কালে অগ্রদ্বীপ থেকে গোপীনাথের আসা বন্ধ হলে কয়েক বছর চিত্রপট ব্যবহারের পর ২০১৮ সালে নতুন গোপীনাথ বিগ্রহ নির্মাণ করে রথযাত্রা সম্পন্ন হচ্ছে। প্রায় দু’শো বছরের প্রাচীন ওই রথযাত্রা কৃষ্ণনগর নতুনবাজারের গোপীনাথ মন্দির থেকে সামান্য কিছু দূরের নতুন বাজার মোড় পর্যন্ত যায়।
পালচৌধুরী বাড়ির রথ
প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত ব্যবসায়ী কৃষ্ণ পান্তি। মহারাহ শিবচন্দ্র তাঁকে চৌধুরী উপাধি দেন। তাঁরই আমলে শুরু হয় রথযাত্রা। এই রথের বৈশিষ্ট্য পালচৌধুরীদের পারিবারিক দেবতা নারায়ণ ওই রথে চড়ে। যদিও তাঁদের নিজস্ব মন্দিরে নিয়মিত জগন্নাথ দেবের নিত্যপূজা হয়। রথের দিন ওই মন্দিরের চারপাশে সাত বার প্রদক্ষিণ করে নারায়ণ। আর জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরে বসে তা উপভোগ করে।
ইসকনের রথযাত্রা
ইসকনের রথ প্রথম যাত্রা করেছিল ১৯৬৭ সালে সানফ্রান্সিসকোয়। প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণ ভক্তিবেদান্ত স্বামীর আয়োজনে। পরবর্তী কালে সেই রথ পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মায়াপুর ছাড়াও ইসকনের রথযাত্রা হয় হবিবপুর।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ছাড়াও রাধামাধব, এবং গৌর নিতাই রয়েছে। মঙ্গলবার হবিবপুরে ইসকনে নামমাত্র রথ হবে। তা-ও, মন্দির চত্বরে। অন্য বার তিন কিলোমিটার দূরে রানাঘাট শহরের স্বাস্থ্যোন্নতি ময়দানে মাসির বাড়ি তৈরি করা হয়। সেখানেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা ন’দিন থাকে। এবার মন্দিরেই একটি প্যান্ডেল করে মাসির বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাদের বসানো হবে। ছোট একটি রথ মন্দিরে মধ্যে ঘুরবে। তবে, ভক্তরা চাইলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন। এ বার কোনও রথই পথে নামবে না। দড়ি ধরে টানা হবে না, চিনি-কলা দেওয়া যাবে না। পাঁপড় জিলিপি পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
আষাঢ়ের অপরাহ্ণ। নীলাচলের পথে চলেছেন একদল বৈষ্ণব। খোলা গলায় তাঁরা পরিষ্কার বাংলা গাইছেন মহাজন পদ। ‘বহুদিন পরে বধূঁয়া এলে, দেখা না হইত পরান গেলে। ছিল প্রাণ তাই দেখা হল, তোমার কুশলে আমার কুশল।’ পুরীর ‘শ্রীরাঘবের ঝালি সমর্পণ’ অনুষ্ঠানের অনুকরণে পতিতপাবন জগন্নাথের ঝালি সমর্পণ চৈতন্যধামে এ বার হল না। তবে আসছে বছর আবার হবে!
তথ্য সহায়তা: সৌমিত্র সিকদার