নিজস্ব চিত্র।
শুরু হয়েছিল বুধবার দুপুর থেকে। তার পর লাগাতার তিন দিন ধরে নাগাড়ে পড়ছে বৃষ্টি। নবদ্বীপের মানুষ রসিকতা করে বলছেন, ‘‘বৃষ্টি তো নয় যেন চব্বিশ প্রহরব্যাপী নাম সঙ্কীর্তন।’’ তিন দিন হয়ে গেল বৃষ্টি ধরার নাম নেই। মাঝে মাঝে একটু বিরতি দিয়েই পরক্ষণে মুষলধারে নেমে আসছে। বৃহস্পতিবার সারাদিনে যেখানে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৫ মিলিমিটার শুক্রবার তা বেড়ে হয়েছে ২৩ মিলিমিটার। সংলগ্ন বর্ধমানে গত চব্বিশ ঘণ্টায় গড়ে ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, শনিবারের আগে আকাশ পরিষ্কার হওয়ার সম্ভবনা নেই। দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো—মাত্র পনেরো দিনের ব্যবধানে জোরালো নিম্নচাপের জেরে মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের।
চাষিরা জানাচ্ছেন, দাপুটে বৃষ্টির সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া, দুইয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে নুইয়ে পড়েছে রত্না, ক্ষিতীশ, আইআর ৩৬, আইআর ৬৪ বা মিনিকিটের মতো স্বল্পকালীন মেয়াদের ধানগাছ। কৃষি পরিভাষায় এদের বলা হয় ‘জলদি আমন’। মূল আমন বা ‘লালস্বর্ণ’ প্রজাতির ধানের সপ্তাহ দুয়েক আগেই কাটা হয় বলে উচ্চ ফলনশীল ধানগুলির এমন নামকরণ। গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে প্রবল নিম্নচাপের জেরে জমিতে কেটে রাখা ধান নষ্ট হওয়ার উপক্রম।
চাষিদের একাংশ জানাচ্ছেন, এখন মাঠের যে সমস্ত ধানের শিস হচ্ছে বৃষ্টিতে জলে ধানের দানা হবে না। ফলে ফলন অর্ধেক হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। অকাল বর্ষণে সদ্য শিস হওয়া ধানের ফলন কমে যাবে। আবার বৃষ্টির সঙ্গে জোরালো হাওয়ায় ধানগাছ জমিতে শুয়ে পড়েছে। করিমপুরের ধান চাষি অসীম সরকার বলেন, “এক বিঘা জমিতে মিনিকিট বুনে ছিলাম। সেই পাকাধান কাটার পর জমি থেকে ঘরে তুলতে পারিনি। বৃষ্টি এসে পড়ায় জমিতে পড়ে আছে। শীঘ্রই রোদ না উঠলে ধানে পচন ধরবে।”
চাষিদের আশঙ্কা, সরষে ও কলাই চাষেও ক্ষতি হবে। যাঁরা উঁচু জমিতে সরষে বুনেছেন তাঁদের সমস্যা না হলেও নিচু জমির বীজ নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে জমি শুকিয়ে নতুন করে বীজ বুনতে অনেক দেরি হবে।
অসময়ে এই বৃষ্টিতে ধান থেকে আনাজ, ফুল থেকে তৈলবীজ—চাষের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। নদিয়ার করিমপুর থেকে বর্ধমানের কালেখাঁতলা, গোয়াস থেকে গয়েশপুর চাষিদের কপালে ভাঁজ গভীর হচ্ছে। লাগাতার বৃষ্টির জেরে সবচেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা যাবতীয় আনাজ, শীতকালীন ফসল থেকে শুরু করে ফুল, তৈলবীজ এবং বিশেষ করে পেঁয়াজ চাষের।
জেলার এক রসুন চাষি জাকির মণ্ডল জানান, তাঁর দু’বিঘা জমিতে দিন চারেক আগেই রসুন রোপণ করে সেচ দিয়েছেন। এই বৃষ্টিতে রসুনের গোড়ায় জল জমে রসুন পচে যাবে। এ জন্য তাঁর বিঘা প্রতি প্রায় ষোলো হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবার রহমতপুরের চাষি সন্তোষ মণ্ডল জানান, তেহট্ট মহকুমা জুড়ে অনেক জমিতে এখন পেঁয়াজ, রসুন লাগানোর তোড়জোড় চলছে। যে জমিতে পেঁয়াজ-রসুনের গাছ বেরিয়ে গিয়েছে তাঁদের সে ভাবে ক্ষতি না হলেও যারা এক সপ্তাহের মধ্যে গাছ বুনে সেচ দিয়েছেন তাঁদের চরম ক্ষতি হবে। দাম বেশি হওয়ায় দ্বিতীয় বার কিনে জমিতে রোপণ করা অনেক চাষির পক্ষে সম্ভব হবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পর পর দু’টি নিম্নচাপের ফলে পেঁয়াজ চাষ বেশ পিছিয়ে গেল। আবহাওয়া ভাল হয়ে জমিতে জো আসতে কয়েক দিন সময় লাগবে। সাধারণত, কার্তিক মাসের কুড়ি তারিখের পর পেঁয়াজ-রসুন রোপণ করলে চাষির ঘরে ফসল উঠতে দেরি হয়। তাই দাম অনেকটাই কম পাওয়া যায় বলে তিনি জানান।
নদিয়ার উপ-কৃষি অধিকর্তা রঞ্জন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘গত ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও আশঙ্কার কারণ দেখছি না। তবে ফুল এবং আনাজের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হবে। আমরা সমস্ত ব্লককে সতর্ক করে দিয়েছি। আবহাওয়ার দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে।”
আবার নদিয়া লাগোয় পূর্বস্থলী, কালনায় গত ২৪ ঘণ্টায় গড় বৃষ্টির পরিমাণ চল্লিশ মিলিমিটার। বর্ধমানের সহ-কৃষি আধিকারিক পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘ফসল পাকার সময়ের নিরিখে তিন রকমের আমনের চাষ হয়। তার মধ্যে জলদি আমন ১১০-১১৫ দিনের মধ্যে পেকে যায়। এখনই জলদি আমন কাটার সময়। এই বৃষ্টিতে জলদি আমনের বেশ ক্ষতি হল। পাশাপাশি অসময়ের বর্ষায় আমনে ছত্রাকঘটিত রোগ ছড়িয়ে ফলন কমার আশঙ্কাও করছেন চাষিরা।’’