প্রতীকী ছবি।
চার বছর ধরে মুম্বইয়ে কাজ করছি। সেখানে অনেকেই চেনা হয়ে গিয়েছেন, একেবারে গ্রামের পড়শির মতো। সেই সব চেনা মানুষকেও এমন অচেনা হয়ে উঠতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দিনমজুরির কাজ করতে মুম্বই গিয়েছিলাম। তখন থাকা-খাওয়া খরচ করার পরেও হাতে কিছু থাকত। এখন আমি রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছি। ইদের মাস পাঁচেক আগে গ্রামের আরও পাঁচজন কে নিয়ে মুম্বই গিয়েছিলাম। সারে চার মাস ভালই কাজ হয়েছিল। নিজের খাই খরচ ছাড়াও বাড়িতে হাজার দশেক টাকা পাঠাতে পেরেছিলাম।
জনতা কার্ফুর প্রথম রাতেই কু ডেকেছিল। মনে হয়েছিল এ বার আর সুদিন থাকল না। বাস্তবে তাই ঘটল। প্রথমে তিন সপ্তাহের লকডাউন, ভাবলাম, মাসটা টেনে হিঁচড়ে পার করে দিতে পারলে ফের ভাল দিন আসবে। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বাড়তেই থাকল। বুঝলাম, এ বাবে থাকলে বাড়িতে টাকা পাঠানো দূরের কথা, শুকিয়ে মরব।
তাই জেলার ৩০ জন শ্রমিক মিলে টাকা জোগাড় করে ফান্ড করলাম, তার পর বেরিয়ে পড়লাম। আর তখনই টের পেলাম পাঁচ বছরে মুম্বইয়ে পরিচিতরা কেমন অচেনা হয়ে গেছি। আনাজপাতি থেকে মুদিখানার জিনিসপত্র আচমকা দ্বিগুণ হয়ে গেল। আলু ৬০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ৫০ টাকা। খাব কী ঝাঁঝেই মরে যাব!
লকডাউনের ৫২দিনে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে, কেন নিজের গ্রাম ছেড়ে এখানে এসেছি! তবে বাড়ি ফেরাটা আমাদের কাছে বেশ মুস্কিলের ছিল। সরাসরি ট্রাক ভাড়া করে বাড়ি ফেরার সাহস প্রথমে হয়নি। কিন্তু আশেপাশের অনেকে একত্রিত হয়ে সাহস পেয়ে শেষতক বাড়ি ফেরাই ঠিক করলাম।
ট্রাকে চেপে বাড়ি ফিরতে চার দিন সময় লেগেছিল। তার জন্য ছ’জন মিলে ৮০ টাকা কেজি দরে মুড়ি আর ৬০টাকা কেজির শসা খেয়েই রাস্তাটা কাটল। এক বার শুধু রাস্তায় আমাদের গাড়ি থামিয়ে খিচুড়ি খাইয়ে ছিল কিছু মানুষ, ঝাড়খন্ড এলাকাতেও একবার খিচুড়ি খেয়েছিলাম।
এমনকি মুম্বইয়েও আমাদের কোন দিন খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি। পুরো রাস্তা পেড়িয়ে আসার পর ঝাড়খণ্ডে আমাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেখান থেকে একটি অন্য ট্রাকে উঠে বাড়ি ফিরি। ফেরার সময়ে প্রতি দিন মনে হয়েছে, দু’টো বাড়তি পয়সা আয়ের জন্য কত কিছুই না খোয়াতে হল। হয়ত রুজির টানেই ফের এক দিন অন্য রাজ্যে ভেসে পড়ব। তবে মানুষের প্রতি আর বিশ্বাস থাকল না, যাঁদের যেভাবে চিনতাম, তাঁরা যে আর তেমনটি থাকলেন না!