কৃষ্ণনগরের ‘নীল দুর্গা’। —নিজস্ব চিত্র।
এখানকার দুর্গাপুজো বেশ প্রাচীন। কিন্তু প্রথাগত দুর্গামূর্তির মতো প্রতিমা নয়। এখানে দুর্গার গায়ের রং অপরাজিতা ফুলের মতো নীল। প্রতি বছর কৃষ্ণনগরের ‘নীল দুর্গা’কে দেখতে উপচে পড়ে দর্শনার্থী ভিড়। কিন্তু দুর্গার গায়ের রং নীল হল কেন? কী এর ইতিহাস?
২৯০ বছরের প্রাচীন এই পুজোর শুরু বাংলাদেশে। আরও স্পষ্ট করে বললে, বরিশালের বামরাইত গ্রামে। তবে ১৯৪৬ সালে দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এ দেশে চলে এসেছিলেন বরিশালের চট্টোপাধ্যায় পরিবার। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের নাজিরাপাড়ায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। নতুন মুলুক, নতুন বাড়ি, নতুন প্রতিবেশী— শত প্রতিকূলতার মধ্যেও চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দেবী আরাধনায় ছেদ পড়েনি। ১৯৪৭ সাল থেকে নাজিরা পাড়ায় শুরু হয় নীল দুর্গার আরাধনা। তবে দেবীর এই গাত্রবর্ণ নিয়ে রয়েছে একাধিক কাহিনি। মার্কণ্ডেয় পুরাণেও এই নীল দুর্গার কথা পাওয়া যায়।
তবে কৃষ্ণনগরের চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের দুর্গার অতসী বর্ণ অপরাজিতায় পরিবর্তিত হওয়ার পিছনে রয়েছে মৃৎশিল্পীর একটি ভুল। রাত জেগে কাজ করতে গিয়ে নাকি বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী ভুল করে দুর্গা প্রতিমাকে অপরাজিতা রঙে রাঙিয়ে ফেলেন। এ দিকে রাত পোহালেই পুজো। সময় কোথায় নতুন করে রং করার! এ দিকে সকাল হতেই পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা প্রতিমা দেখতে এসে থ! সব কিছু শুনে তাঁরা শিল্পীর পাশে দাঁড়ান। চট্টোপাধ্যায় বাড়ির এক বয়স্ক সদস্য জানান, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমন একটা কিছু হবে। কারণ, রাতেই দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারে তিনি অপরাজিতা রূপেই পূজিত হবেন। সেই শুরু। তার পর থেকে মৃৎশিল্পীর ভুলই হয়ে উঠল ঐতিহ্য। আজও কৃষ্ণনগর নাজিরা পাড়ায় পূজিতা হন নীল দুর্গা হয়ে।
আগে পুজো ছিল একটিই। কিন্তু পরবর্তীতে শরিকি সমস্যায় পুজোর সংখ্যাও বাড়ে। ১৯৯৮ সাল থেকে দু’টি পুজো শুরু হয় এই পরিবারে। ওই প্রতিমারও বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। শাক্ত মতে এই পুজোয় প্রথমে মোষ বলি দেওয়া হত। পরে শুরু হয় পাঁঠা বলির প্রথা। এখন অবশ্য আর বলি হয় না। সন্ধিপুজোর আগে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল। দুর্গার ভোগেও আছে নানা বৈচিত্র। মহাপ্রসাদের পাশাপাশি পোলাও, মাছ, পাঁচ রকম ভাজা, তিন রকম সব্জি থাকে মায়ের ভোগে।
নবমীর দিন হয় শত্রুনিধন পর্ব। আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় ‘নর’ অবয়ব। তাকে লাল শালুতে মুড়ে পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য খাঁড়া দিয়ে বলি দেন। দুই পরিবারেই একচালি প্রতিমা তৈরি হয়। উল্টো দিকে অর্থাৎ বাম দিকে থাকেন সরস্বতী, গণেশ এবং ডান দিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক।
প্রায় ৩০০ বছর ধরে দু’দেশের ভৌগোলিক গণ্ডি পেরিয়েও পুজোর উপচার ও পুজো প্রকরণের নিজস্বতা ধরে রেখেছে চট্টোপাধ্যায় পরিবার। ওই পরিবারের এক সদস্য মৃণাল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “পুজোর প্রথম বছর যে ভাবে মা পূজিতা হয়েছিলেন, ঠিক একই ঐতিহ্য মেনে আমরা আজও পুজো করছি। তবে সময়ের দাবি মেনে কুমারী পুজো এবং পশু বলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
কালের প্রভাবে নিয়ম বদলেছে। জৌলুসেও খানিক ভাটা পড়েছে। তবুও প্রতি বছর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এমনকি, পড়শি জেলা থেকেও পুজোর ক’টা দিন কৃষ্ণনগর নাজিরা পাড়ার নীল দুর্গাকে দেখতে উপচে পড়ে ভিড়। উৎসব, ঐতিহ্য এবং নানা গল্পকথার মোড়কে আজও মুখে মুখে ফেরে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নীল দুর্গার কাহিনি।