Dengue

ডেঙ্গির ‘সর্বনাশে’ কারও ‘পৌষ মাস’, বেসরকারিতে ‘চড়া’ বিলে হিমশিম খাচ্ছে রোগীদের পরিবার

প্রশাসনিক সূত্রে খবর, রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে শুরু থেকেই উপরের দিকে রয়েছে নদিয়া। ঊর্ধ্বমুখী রেখচিত্র জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।

Advertisement

প্রণয় ঘোষ

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৩ ২১:৫৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

জ্বর ও ডেঙ্গির উপসর্গ নিয়ে তিন দিন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকে মিলেছে শুধু প্যারাসিটামল আর স্যালাইন। তীব্র জ্বর নিয়ে ৭২ ঘণ্টা হাসপাতালের মেঝেতে কাটানোর পরেও জোটেনি শয্যা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই সরকারি হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে কৃষ্ণনগর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে পালপাড়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয় বেতাইয়ের গৃহশিক্ষক শুভঙ্কর কুন্ডুকে। কিন্তু চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে ‘মাথায় হাত’ শুভঙ্করের পরিবারের! অন্য সময়ে নার্সিংহোমের সাধারণ শয্যার খরচ যেখানে দিনে ৫০০-৭০০ টাকা, ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তে তা বেড়ে দু’হাজারে ঠেকেছে। আইসিইউ শয্যার খরচও বেড়েছে ৩৫-৪০ শতাংশ! শুধু কৃষ্ণনগরই নয়, করিমপুর, কল্যাণী, রানাঘাট, চাকদহ— নদিয়ার প্রায় সর্বত্রই বেসরকারি নার্সিংহোমে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় মোটা অঙ্কের বিল ধরানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছে বহু পরিবার। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Advertisement

নদিয়ায় এই মুহূর্তে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ১,৪৮৬ ( বৃহস্পতিবার পর্যন্ত)। সরকারি সূত্রে দাবি, ৭০০ জন ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। বাকিরা এখনও চিকিৎসাধীন। বেসরকারি হিসাবে জেলায় ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা অবশ্য দু’হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। শুধু রানাঘাট ও হাঁসখালি ব্লকে সংখ্যাটা হাজার পেরিয়েছে বলে দাবি জেলার স্বাস্থ্য মহলের একাংশের। এই পরিস্থিতিতে গাদাগাদি অবস্থা সরকারি হাসপাতালগুলিতে। কোথাও একই শয্যায় চার জন রোগী রয়েছেন, কোথাও আবার মেঝেতে রেখেই রোগীদের চিকিৎসা চলছে! তার পরেও হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগ, এই অবস্থায় বাড়তি মুনাফা তুলতে নেমে পড়েছে বেসরকারি নার্সিংহোমগুলি। ডেঙ্গি আক্রান্ত সাত বছরের সন্তানকে কল্যাণীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন বাদকুল্লার বাসিন্দা আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালে তিন দিন রেখেছিলাম ছেলেকে। কিন্তু বেড পাইনি। প্লেটলেট লাগাতার কমছিল। তা-ও কেউ কিছু করছিলেন না। বাধ্য হয়েই নার্সিংহোমে ভর্তি করাই। এখানে যা বিল বলছে, আমাদের পক্ষে তা দেওয়া সত্যিই মুশকিল।’’

প্রশাসনিক সূত্রে খবর, রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে শুরু থেকেই উপরের দিকে রয়েছে নদিয়া। ঊর্ধ্বমুখী রেখচিত্র জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। জেলার মধ্যে ডেঙ্গির ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে রানাঘাট শহর এবং গ্রামীণ এলাকা। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এত দিন করিমপুর, পলাশিপাড়া, চাপড়া ও কৃষ্ণনগরে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এখন সেখানেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে জেলা স্বাস্থ্য মহলের একাংশের অভিযোগ, হাসপাতালগুলিতে ‘ফিভার ক্লিনিক’ চালু হওয়ায় কথা থাকলেও তা এত কম সময়ে সম্ভব হয়নি। মহকুমা হাসপাতাল ছাড়া নিয়মিত ডেঙ্গির এলাইজা পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই কোথাও। মাল্টিস্পেশালিটি ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলিতে গড়ে প্রতি দিন ২৫০-৩০০ রোগী ডেঙ্গির উপসর্গ নিয়ে আসছে। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে। হাসপাতালে রোগীদের অতিরিক্ত ভিড় সামলাতে নাজেহাল চিকিৎসক এবং নার্সেরা। বিশেষ পরিষেবা তো দূরের কথা ন্যূনতম স্যালাইন ও প্যারাসিটামল পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের কর্মীরা। এর জেরে বাধ্য হয়েই রোগীদের বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলি। কিন্তু সেখানেও চিকিৎসার বিপুল খরচের ভারে বিপাকে সাধারণ মানুষ! বহু পরিবারের অভিযোগ, ডেঙ্গি আক্রান্তদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের সুবিধাও মিলছে না।

Advertisement

রানাঘাটে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে জেলার একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি আক্রান্ত বাবাকে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা সম্মুখীন হয়েছে পিয়ালী বসু। তিনি বলেন, ‘‘রেট চার্টে বলা আছে, সাধারণ বেডের ক্ষেত্রে দিনে দেড় হাজার টাকা। ডেঙ্গির উপসর্গ থাকায় আরও হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে এখন। এ ছাড়াও ডেঙ্গি-সহ আনুষাঙ্গিক পরীক্ষার খরচও ৩০-৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডেও কোনও পরিষেবায় মিলছে না।’’ এ ব্যাপারে বেসরকারি হাসপাতালগুলির দাবি, যে সব রোগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের সুবিধা পাওয়া যায়, তার মধ্যে ডেঙ্গি নেই। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ-ও বক্তব্য, স্বাস্থ সাথী কার্ডের বকেয়া টাকা মেটায়নি রাজ্য সরকার।

যদিও জেলা স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ এবং বি ক্যাটাগরিতে থাকা বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম থেকে স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের মাধ্যমে ডেঙ্গির চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। তারা যদি এই পরিষেবা দিতে অস্বীকার করে, সে ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করাই যায়। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জ্যোতিষ দাস বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য সাথী নিয়ে নির্দেশিকা ছিল। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী আরও কিছু নির্দেশিকা দিয়েছেন। বি ক্যাটাগরির বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে, যেখানে নন সার্জিক্যাল কেসের ক্ষেত্রেও কভারেজ দেওয়া হয়, সেখানে নিয়ম ভাঙার কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি লাইসেন্স পর্যন্ত বাতিল করা হতে পারে।’’ জেলাশাসক শশাঙ্ক শেঠিও বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের ক্ষেত্রে যা নিয়ম আছে, তা সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমকে মানতে হবে। ডেঙ্গি রোগীদের থেকে আলাদা করে বাড়তি টাকা নেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে যদি নির্দিষ্ট অভিযোগ জমা পড়ে, আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement