প্রতীকী ছবি।
গত ২৫ মার্চ, শনিবার শেষ বার ব্যান্ডেল লোকাল থেকে শেষ বার নেমেছিলেন নবদ্বীপ ধাম স্টেশন লাগোয়া শ্রীরামপুরের বাসিন্দা নিবাস দেবনাথ। পেশায় তাঁত ব্যবসায়ী। আট মাস হতে চলল, আর ট্রেনে চড়ার সুযোগ পাননি মধ্যবয়স্ক মানুষটি। প্রায় বিশ বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন আবাসনে তাঁতের শাড়ি বিক্রি করে আসছেন তিনি।
সোমবার ঈষৎ উত্তেজিত ভাবেই নিবাস বলেন, “স্টেশনে প্রায় রোজই আসি। প্রথম দিকে মনখারাপ হত। এখন কিন্তু অসম্ভব রাগ হচ্ছে। ট্রেন আসছে-যাচ্ছে অথচ আমরা উঠতে পারছি না। এই পুজোর সময়ে বেকার বাড়িতে বসে আছি। সবই যখন খুলে দিয়েছে তখন, ট্রেনের দোষ কোথায় বুঝতে পারছি না। কবে চলবে ট্রেন, আমরা অনাহারে মারা গেলে?”
একই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নবদ্বীপ থেকে নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর থেকে কল্যাণী, বেথুয়াডহরি থেকে বাদকুল্লা— সর্বত্র। লোকাল ট্রেন কবে চলবে তা জানতে চান নিত্যযাত্রী থেকে হকার, প্ল্যাটফর্মের চায়ের স্টলের মালিক থেকে স্টেশনের টোটো স্ট্যান্ড। ট্রেন চলার সঙ্গে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা নিয়ে যে তাঁদের বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা আছে, তা বোঝার উপায় নেই।
অনেকে আবার অন্য যুক্তিও দিচ্ছেন। কুপার্সের গ্রামীণ চিকিৎসক দেবাশিস মণ্ডলের মতে, “ট্রেন চালু করা খুব দরকার। বাদুড়ঝোলা বাস চলছে, বেপরোয়া ভিড় শপিংমলে। পুজোর বাজারে লোক উপচে পড়ছে। শুধু ট্রেন চললেই অসুবিধা? কলকাতা থেকে বাসে বাড়ি ফিরছি, সাত ঘণ্টা লাগছে। এ ভাবে কত দিন চলব?”
চাকদহ সেণ্ট্রাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুবল দেবনাথের যুক্তি, “শুধু চাকদহ স্টেশন থেকেই রোজ কমবেশি ৭০ হাজার রেলযাত্রী চলাচল করেন। আট মাস ধরে তাঁদের অবস্থা আঁচ করতে পারছেন?” ট্রেন বন্ধ হওয়ায় নবদ্বীপ থেকে বাসে কলকাতার অফিসে যেতে হচ্ছে রামী সিংহকে দৈনিক ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়ে। জুন থেকে এ ভাবেই চলছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরও আর ধৈর্য থাকছে না। তাঁরও প্রশ্ন, “এ ভাবে আর কত দিন?”
বিভিন্ন স্টেশনের নিত্যযাত্রী সমিতি কর্তাদের কাছেও এই সব প্রশ্ন আসছে লাগাতার। কৃষ্ণনগর-কালীনারায়ণপুর রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক প্রীতম ভৌমিক বলেন, “কাজের প্রয়োজনে বাসে সাপ্তাহিক কলকাতা যাতায়াত আমাকেও করতে হচ্ছে। খরচ যেমন বেশি, তেমনই অবর্ণনীয় ভিড়। আর রাস্তার যা হাল! নিয়মিত যাওয়া অসম্ভব।” তবে সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “মনে রাখতে হবে, একটা বাসে যত যাত্রী যাতায়াত করেন তার বহু গুণ বেশি লোক ট্রেনে যাবেন। সেই বিপুল সংখ্যাকে যদি উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধির সুরক্ষা দেওয়া না যায়, তা হলে বড় বিপদ ঘটতে পারে।”
এ দিকে হাওড়া-কাটোয়া সুবার্বন প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন রেল চালানোর দাবিতে ‘পোস্টার প্রচার’ শুরু করছে। সম্পাদক সৌমেন অধিকারী বলেন, “বিরাট সংখ্যক মানুষের আয়ের উৎস আট মাস বন্ধ। এখন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। আমরা একাধিক স্মারকলিপি দিয়েছি। কিচ্ছু লাভ হয়নি। যাত্রিসংখ্যা কমিয়ে, ট্রেন বাড়িয়ে বা মেট্রোর মতো কোনও ব্যবস্থা করে লোকাল ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা হোক।”
রানাঘাট ব্যবসায়ী সমিতির নেতা পিন্টু সরকারের যুক্তি, “বাসেও তো ভিড় হচ্ছে। সতর্কতা অবলম্বন করে ট্রেন চালালে মানুষ বরং নিরাপদও থাকবে, আবার আর্থিক ক্ষতির হাত থেকেও রেহাই পাবে।” তবে লোকাল ট্রেন যে পরিমাণ মানুষের চলাচল বাড়িয়ে দেবে তাতে যে বিপদ বাড়তে পারে, তা অনেকেই অস্বীকার করছেন না। ভবানীপুরের অফিসে নিয়মিত যেতে হচ্ছে সরকারি চাকুরে বিকাশ দাসকে। তবু বিকাশ বলেন, “ট্রেন চললে তো খুবই ভাল। তবে যে ভাবে এখনও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সে কথাটাও মাথায় রাখতে হবে। লোকাল ট্রেন করোনার নতুন বাহক না হয়ে ওঠে!”ফয়সালা কবে হবে কেউ জানে না।