চোখ ভেসেছে বিসর্জনের জলে 

বাড়িটায় এখনও ঝুপসি হয়ে ঝুলে রয়েছে কাঁচা শোক। চোখের কোণে এখনও জল শুকোয়নি। 

Advertisement

সম্রাট চন্দ

বাদকুল্লা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:০৮
Share:

ছেলে কোলে মৌসুমী। নিজস্ব চিত্র

এই তো সে দিন।

Advertisement

এই তো। হাতের নাগালেই।

সে দিনও কত কথা, কত রকম হিসেবনিকেশ। পুজোয় কী কেনা হবে, কত কী করা হবে।

Advertisement

বাড়িটায় এখনও ঝুপসি হয়ে ঝুলে রয়েছে কাঁচা শোক। চোখের কোণে এখনও জল শুকোয়নি।

“এ বছর বাপের বাড়ি যাব। ছেলেটাকে কারও না কারও সঙ্গে তো পুজোর মণ্ডপে পাঠাতে হবে। বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখাটাই তো আর হবে না ওর কোনও দিন”— আস্তে আস্তে হবলে বাবুলালের ছেলে এক বছরের অর্পণের এ বারই প্রথম ঠাকুর দেখতে বেরোনোর কথা। প্রতি বছর এই সময়টায় বাড়ির সবার জন্য নিজেই পুজোর বাজার করতেন বাবুলাল। এই বছর ছেলের জন্য জামা কিনতে হবে, সেটা ছিল একটা বাড়তি উত্তেজনা।

ঘরে ঢোকার মুখে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মৌসুমী, “ওর বাবা এই বছর জামা কেনার কথা বলে রেখেছিল। আর কয়েক দিন পরেই যাওয়ার কথা ছিল। পুজোর বাজারটা আর হয়নি।” তিন বছরের বিবাহিত জীবন। প্রতি বার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই বাদকুল্লা বাজারে যেতেন বাবুলাল। স্বামীর মোটরবাইকে চেপেই বাদকুল্লার জমজমাট পুজোমণ্ডপে যাওয়া, বিয়ের পর পুজোয় এটাই ছিল রুটিন।

সেই রুটিনে ছেদ পড়েছিল গত বছর। ছেলের বয়স তখন তিন মাস। ধানতলার পেতুয়ায় বাপের বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে ছিলেন মৌসুমী। পুজোর মধ্যে এক দিন গিয়েছিলেন বাবুলাল। সেই এক দিনই স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ির আশপাশে ঠাকুর দেখতে বেরোন মৌসুমী। সেই শেষ। একরত্তি অর্পণ বোঝেনি, এখনও বাবা ফিরবে না আর কোনও দিনই। মৌসুমী বলেন, “ছেলেটার তো বোঝার বয়স হয়নি। তবে বাবার অভাব যে বোধ করে, তা বুঝি। বাবাকে খোঁজে।”

বাদকুল্লা ২ পঞ্চায়েতের বুক চিরে চলে যাওয়া বাদকুল্লা-হাঁসখালি রাস্তার ধারে দোসতিনা বাগদিপাড়া। গত ৭ সেপ্টেম্বর ওই রাস্তাতেই খুন হন সিপিএমের সর্বক্ষণের কর্মী বাবুলাল। আটপৌরে বাড়িটাকে ঘিরে শোকের ছায়া এখনও স্পষ্ট।

পাড়ায় ঢুকতেই, কংক্রিটের রাস্তা ছেড়ে বাড়িতে নামলে চিলতে উঠোন। সেখানে বসে আনাজ কুটছিলেন শেফালি বিশ্বাস, খুন বাবুলালের মা। পাশে বাবুলালের স্ত্রী মৌসুমী। হাতের কাজ সারতে-সারতে শেফালি বলেন, “প্রতি বছর ছেলেটাকে বলতাম, নতুন শাড়ি কেনার দরকার নেই। আগে একটু টাকাপয়সা জমা। কে শোনে কার কথা! বলত, পুজোয় তোমায় কিছু না দিলে হয় নাকি!”

বলতে-বলতেই থেমে গিয়ে চোখ মুছে নেন শেফালি। মেঘলা দুপুরে আকাশ থেকেও চুঁইয়ে নামছে বিষণ্ণ জল। সে দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে শেফালি বলে চলেন, “মায়ের মৃত্যুর পরে ছেলে পারলৌকিক কাজ করে। আর আমি এমন অভাগা চোখের সামনে ছেলের ভাসান দেখলাম। পুজো আর কী, আমার ছেলেরই তো বিসর্জন হয়ে গিয়েছে।”

মেঘটা খুব ঝুঁকে এসেছে। এই বুঝি ফের অঝোরে বৃষ্টি নামল...।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement