প্রতীকী ছবি।
প্রশ্নটা প্রচ্ছন্ন ভাবে ঘুরছে ঠিকই, অস্বস্তিও যে নেই তা নয়, তবে তা নিয়ে সঙ্কুচিত নন ওঁরা। বরং কোভিড-যুদ্ধে, পিছিয়ে না থেকে, গত তিন মাস ধরে সামনে থেকে যে ভাবে প্রতিপক্ষ ভাইরাসকে চ্যলেঞ্জ জানিয়ে এসেছেন, সোমবার তাঁদের সহকর্মীকে হারানোর পরেও সেই জায়গা থেকে সরে আসতে নারাজ তাঁরা।
হুগলির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পরেও তাই জেলার করোনা-লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সরকারি আমলা-কর্মীরা এখনও জোর গলায় বলছেন—‘নিজেকে নিয়ে ভাবনা পরে, কোভিড-লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে।’
লকডাউনের সময় দু’মাস ধরে কখনও টেরেনে কখনও বা ট্রাক কিংবা সরকারি উদ্যোগে বাস বোঝাই হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা জেলায় ফিরেছেন। তাঁদের বাস থেকে নামিয়ে পরীক্ষা করা। খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দেওয়া, স্থানীয় বাস বা গাড়ির ব্যবস্থা করে বাড়ি পাঠানো কিংবা পইপই করে বোঝানো, নিয়ম বিধিগুলো ঠিক কী— গত আড়াই মাস ধরে জেলার বেশ কয়েক জন আমলা বা সরকারি কর্মী-অফিসার নাওয়া খাওয়া ভুলে সে কাজটা করে গিয়েছেন। হুগলির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক এই কাজটাই করতে গিয়ে করোনা সংক্রমণে পড়েছিলেন। পরিণতিতে মৃত্যু। তবে, দেবদত্তা রায় যেন, বাড়তি সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন ওঁদের। সামনের সারিতে থেকে কোভিড-যুদ্ধ পরিচালনা করা জেলার বেশ কয়েক জন আমলা তাই সমস্বরে বলছেন, ‘‘খুবই দুঃখজনক দেবদত্তার চলে যাওয়া। কিন্তু আমরা ওঁর কাজটাই যেন করে যাচ্ছি!’’ এক আমলার কথায়, ‘‘এটা (দেবদত্তার মৃত্যু) আমাদের কাছে অস্বস্তির হতে পারে কিন্তু বাড়তি একটা তাগিদও অনুভব করছি। সবাই যদি ঘরে ঢুকে অফিলে বসে কাজ করেন চলবে কী করে বলুন তো!’’
এই যুদ্ধ সামাল দিতে, কখনও বহরমপুর রেল স্টেশন তো এই স্টেডিয়ামে ছুটে বেড়িয়েছেন জেলা আঞ্চলিক পরিবহন আধিকারিক সিদ্ধার্থ রায়, জেলা ভূমি অধিগ্রহণ দফতরের আধিকারিক সুমন বিশ্বাস। মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি-ভিজে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেছেন চিকিৎসক সুভাষ হালদার। বারংবার সতর্ক করা হয়েছে ঘরে ফেরা পরিযায়ীদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতে। কেউ শুনেছেন কেউ শোনেননি সে কথা। তবু সহানুভুতির সঙ্গে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন মাস্ক, ওষুধ। পাখি পড়ানোর মতো করে পড়িয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি। কাজের তাগিদে ভুলে গিয়েছিলেন করোনা তাঁদেরও আঘাত হানতে পারে।
জেলা ভূমি অধিগ্রহণ দফতরের আধিকারিক সুমন বিশ্বাস, নিজে থ্যালাসেমিয়া বাহক। আড়াই মাস পরে নিজের বাড়ি কাঁথি গিয়েছেন সপ্তাহ খানেকের ছুটিতে। ফোনে বলছেন, “সেই সময় মনে হত মানুষগুলো বিপদে পড়েছে তাঁদের পাশে দাঁড়াব না এটা হয়। আজ দেবদত্তার কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। তবে ভয় পেলে চলবে কী করে বলুন তো!’’ জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক সিদ্ধার্থ রায় বলছেন, “দেবদত্তা তাঁর প্রভেশন পিরিয়ডে আমার সঙ্গে নদিয়াতে কাজ করেছে। দক্ষ আধিকারিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যূ খুবই কষ্টদায়ক। এক সময় আমারও প্রতি সকালে মনে হত গলা ব্যথা করছে। বেলা হতেই সব ভয় উবে যেত কাজের ব্যস্ততায়।’’
পরিযায়ীদের সঙ্গে গায়ে গা ঘেঁষে চিকিৎসা করেছেন চিকিৎসক সুভাষ হালদার। ৫৯ বছর বয়সী এই চিকিৎসক বলছেন, “ভয় করলেও ভাবতাম, ওঁরা তো কোনও দোষ করেননি। তাদেরকে স্বাস্থ্য সচেতন করাই তো আমাদের কাজ। দেবদত্তার খবরটা শুনে থেকে সহকর্মীদের সর্তক করছি ঠিকই, ভয় পেতে বারণও করছি।’’